বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অপসারণই কি সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল? কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত আর তার স্থলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ইউনূসের সরকার গঠন কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। এতো সকালে ভুলে যাওয়ার বিষয় নয় যে, প্রফেসর ইউনূস অদূর অতীতে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে এক রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এই দল গঠনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি দল ভেঙে দিয়েছেন। এ কারণে এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, তিনি ঝানু রাজনীতিবিদ। তবে যে রাজনীতির মোক্ষম অস্ত্র গণযোগাযোগ বা মানুষের কাছে নিজের বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তিনি একজন ‘মাস্টার কমিউনিকেটর’। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের তিনি বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করতে পেরেছেন। আর তাতে দেশের জন্য বয়ে আনতে পেরেছেন নিজের ও গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার। তিনি নিজেকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, ঋত প্রদানে কোনো বন্ধকী ছাড়া ব্যাংকিংয়ের পথ দেখিয়ে তিনি যে, নতুন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন তা ইসলাম পরিপন্থী নয় বলে সৌদি আরবও স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রফেসর ইউনূস আজ তার জনপ্রিছুার শীর্ষে। অবশেষে তাকে কেন্দ্র কইে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলা যায়। তার পরিণত বয়সেই তাকে নতুন করে হাল ধরতে হয়েছে বাংলাদেশের। তার প্রতি সব আস্থা রেখেই আজ বলতে হয়, তিনি যতটা ব্যক্তি সফলতায় সফল হয়েছেন, ততটা কিন্তু রাজনীতিক সফলতা তার নেই। তিনি আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সমর্থন পেয়েছেন, তবে দেশের যে রাজনীতিক পরিমণ্ডল, বাংলাদেশে যে দেশীয় ও আঞ্চলিক শক্তিবর্গের স্বার্থ তাকে সামাল দেওয়ার রাজনৈতিক মেধা নিয়ে প্রশ্ন তো রাখা যায়। প্রফেসর ইউনূস তার রাজনৈতিক কারবার শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতির চর্চা তার কর্ম নয়। তবে কেন তিনি আজ সরকারপ্রধান? তার বিশ্লেষণে পরে আসছি। তবে আমার এখানে মনে হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লকে নিয়ন্ত্রণে প্রফেসর ইউনূসের একজন রাজনৈতিক উপদেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি তার চারপাশে যেসব উপদেষ্টা নিয়েছেন, তার কেউ রাজনীতিক নন। যেসব ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন, তারা কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আন্দোলন শুরু করেননি। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে অবশেষে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী ও স্বেচ্ছাচার পতনের আন্দোলনে পর্যবসিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনার অপসারণ করে গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে মহাযজ্ঞের পুরো বিষয়টি আমেরিকার পক্ষ থেকে তদারক করেছে ‘International Republican Institute (IRI)’ বা আন্তর্জাতিক প্রজাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি সফলতার সঙ্গে ২০১৯ সালের শুরু থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত পুরো বিষয়টির নজরদারি করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানেও ছিল এই প্রক্রিয়ার অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কর্মকর্তা এই প্রক্রিয়ায় দেখভাল করেছেন তা নিয়ে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ক্রীস মারফি, সুমনা গুহ, ডোনাল্ড লিউ, সারাহ মরগান ও ফ্রান্সিসকো বেনকোসন ছিলেন কর্তধার। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ভারত কূটনীতিক মিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বে গণতন্ত্র রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের গৃহিত পন্থার নজির। এই এজেন্সি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অর্থায়নে কাজ করেছে। এই আইআরআই প্রদত্ত ‘দি সানডে গার্ডিয়ান’কে দেওয়া ডকুমেন্টে জানা যায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি ও ইউএসএআইডির বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছে। আপনারা দেখতে পারেন, শেখ হাসিনার অপসারণের পর ইউএসএআইডি পূর্বনির্ধারিত উন্নয়ন বাজেটের ২০ কোটি ডলার অবমুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে গত সেপ্টেম্বর মাসেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে যথেষ্ট স্টেক। তা দৃশ্যত না হলেও অদৃশ্যত বেশ পরিষ্কার। আইআরআইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপকে ভারসাম্যের মধ্যে আনা। আপাতত আমেরিকা তাতে সফল হয়েছে। কিন্তু প্রফেসর ইউনূসের বয়স হয়েছে। ৮৪ বছরের বৃদ্ধ ইউনূস অবশ্য এখনো সচল। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক পরিণত বয়সকে অস্বীকার করার জো নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের এই ক্রান্তিকালে সিদ্ধান্তের জরুরি বিষয় রয়েছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ চেনার বিষয় রয়েছে। নতুন-পুরোনো সংমিশ্রণে প্রশাসন গড়ে তোলার বিষয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের বেনিফিশিয়ারি আমলাদের কবল থেকে সংঘটিত বিপ্লবকে রক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে দেখা গেছে, কিছু স্বার্থান্বেষী ঢুকে পড়েছে। কিছু মেধাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা বিশ্বে বিচরণ করছেন এবং যারা এতোদিন ‘আইআরআইয়ের সঙ্গে অকথিত লিয়াজোঁ করেছেন তাদের জানতে হবে।
বাংলাদেশের পরিবর্তন নিয়ে ভারতে চলছে আলোচনা। আইআরআই সম্ভবত এ নিয়ে এখনো প্রজেক্ট পরিত্যক্ত করেনি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বাবা জয়’ বিভিন্ন ভাষায় গালি দিয়েছে, তিনি ও তার মা তাদের কবলে পড়েছেন। নিজে ভার্জিনিয়ায় হামাগুড়ি দিচ্ছেন। সজীব জয় আমেরিকা থেকে বের হলে তার সব সম্পদ এখানে রেখে যেতে হবে। আর আমেরিকায় তিনি ঢুকতে পারবে কি না বলা যায় না। জয়ের মায়ের ভিসা বাতিল হয়েছে। কাজেই এ নিয়ে ভারতের কিছু করার আছে কি না, জানা নেই। আমেরিকা ভারতকে জিগ্যেস করেছে শেখ হাসিনা এখন কোন আইনে ভারতে আছেন। ভারত বলেছে, তিনি শিগগিরই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে চলে যেতে পারেন। কোন দেশে যাবে তা এখনো জানা নেই। তবে অনেকে মনে করেন, তিনি বাহরাইন, ওমান কিংবা আবুধাবিতে যেতে পারেন।