২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১১:৪২:২৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


দেশকে কনকচাঁপা
২০১৮ এর পর থেকে আমি অলিখিত নিষিদ্ধ
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৯-২০২২
২০১৮ এর পর থেকে আমি অলিখিত নিষিদ্ধ কনকচাঁপা


বাংলা গানের ভুবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কনকচাঁপা। যিনি নিজেকে কণ্ঠশ্রমিক বলে দাবি করেন। তিনি প্রায় চার হাজার গান উপহার দিয়েছেন। এরমধ্যে কালজয়ী গানের সংখ্যাও অনেক। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে। স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির


প্রশ্ন: ইদানিং আপনি গানে অনিয়মিত। এর কারণ কী?

কনকচাঁপা: গানে অনিয়মিত কথাটা ঠিক নয়। বলতে পারেন নতুন গান প্রকাশ হচ্ছে কম। নতুন গান গাওয়ার যে পরিবেশ দরকার সেটা হয়তো আমার মতো করে না পাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। এখন তো অনেকে গায়ের জোরে শিল্পী হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে গান করছে, যেমন খুশি গাচ্ছে। ফলে আমরা ধীরে ধীরে গান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। 

প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনো কাজ না করতে পারার আক্ষেপ আছে?

কনকচাঁপা: আমি একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক হতে চাই। কিন্তু সেটা আসলে কতটুকু সম্ভব জানি না। কারণ মধ্যবয়সে চলে এসেছি, কৃষক হওয়া তো শারীরিক সামর্থ্যেরও একটা ব্যাপার। এরপরও সব পরিকল্পনা, কাজ প্রায় শেষ। আমার স্বপ্নের একেবারে দ্বারপ্রান্তে আছি। ঢাকা শহরে আর থাকবোই না। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকায়; কিন্তু এখানে এখন আমার দম আটকে আসে। প্রকৃতির কাছাকাছি না, একেবারে প্রকৃতির ভেতরে চলে যাচ্ছি। বগুড়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি, সেখানেই আমি অনেক আগে কিছু জায়গা কিনেছি। বিভিন্ন গাছপালা লাগিয়েছি, বাড়ি বানানোর কাজও শেষ প্রায়। আশা আছে এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো।

প্রশ্ন: জীবনের বড় প্রাপ্তি কী?

কনকচাঁপা: মানুষ হিসাবে জন্ম নেওয়া। আরকটি বড় প্রাপ্তি হলো আমার মা-বাবা। তাঁদের ঘরে জন্ম নেওয়াটা অনেক বড় প্রাপ্তি। বশীর আহমদকে ওস্তাদ হিসেবে পেয়েছি। জীবনসঙ্গী হিসেবে মইনুল ইসলাম খানকে পেয়েছি, এটা আমার অনেক বড় একটা পাওয়া। আমি মানুষের জন্য কাজ করি, সেই জায়গা থেকেও রাজনীতিতে উৎসাহ দিয়েছেন তিনি। আমার রাজনীতিতে আসা ভুল নাকি ঠিক হয়েছে, জানি না। কেউ বলেন ভুল হয়েছে, কেউ বলেন ঠিক হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি জীবন হাতে নিয়ে কাজ করেছি। আমার পেছনে একটা গাড়ি সারাক্ষণ অস্ত্র হাতে অনুসরণ করত। আমার স্বামী ভয় পাননি।

প্রশ্ন: ভবিষতে কি আবারও নির্বাচনের পরিকল্পনা আছে?

কনকচাঁপা: আমি মানব সেবক। রাজনীতিবিদ নই। মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে ভালো লাগে। মা আমাকে এই শিক্ষাটা দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, হাতের কাছে যা আছে, তা-ই দিয়েই মানুষকে সহযোগিতা করতেন মা। ধীরে ধীরে আমিও মানুষের জন্য কাজ করা শুরু করলাম। বৃদ্ধাশ্রম ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছি। সিলেটে দুস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। দেখা যায়, মাসে এক-দুই লাখ টাকা চলে যেত। শীতে এক হাজার কম্বল নিয়ে গিয়েছিলাম উত্তরাঞ্চলে, কম্বলের দাম কিন্তু কম নয়। শিল্পীর চুরির পয়সা থাকে না। এক হাজার কম্বল নিমেষেই শেষ, আমি কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় এসেছি। তখন আমার স্বামী বললেন, ‘তুমি দিয়ে শেষ করতে পারবে না। ৫০ কোটিও দান করতে চাইলে নিমেষেই শেষ হয়ে যাবে। তুমি একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে কাজ করো। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছে যাও।’ সেখানে এমপি, মন্ত্রী হওয়ার দরকার নেই। আমার তো একটা পদ আছেই, আমি কনকচাঁপা, কণ্ঠশ্রমিক। প্রথমে আমি আওয়ামী লীগের কাছে গিয়েছিলাম। তখন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য মনোনয়নের সময় তারা আমাকে অভয় দিয়ে মনোনয়নপত্র কিনতে বলেছিল। পরে দেখলাম, না। আমি হইনি। আমি খুবই লজ্জা পেলাম। পড়াশোনা কিংবা গান- সব জায়গায় প্রথম হয়েছি। তারপর চিন্তা করলাম, নিজে যতটুকু পারি কাজ করব। আমি সাধারণ একজন মানুষ। তবে উপার্জন বেশ ভালোই, নিয়মিত ট্যাক্স দিই। তাহলে আমার পয়সা কোথায় যায়? আমি মানুষের জন্য কাজ করি। তারপর দুই বছর বসে ছিলাম, আমার মতো কাজ করেছি। পরে বিএনপি থেকে আমাকে ডেকেছিল। বিএনপিতে যোগ দিলাম। এভাবেই আসলে রাজনীতিতে আসা। একটা কথা আছে না, আমিও ফকির হলাম, দেশেও দুর্ভিক্ষ হলো। আমিও বিএনপিতে যোগ দিলাম, এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল...। এখন যে জিনিসটা দাঁড়িয়েছে, ২০১৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে আমি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, রেডিওতে আমার গান বাজানো হয় না। টিভি চ্যানেলে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর- এমন গর্বের দিনে, জাতীয় দিবসগুলোতে আমি আগে নিয়মিত গান গাইতাম। এখন সেখানে আর ডাকে না।

প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে এমন ঘটনা কবে থেকে ঘটছে?

কনকচাঁপা: ২০১৮ সালে নির্বাচন করলাম, সিরাজগঞ্জে মোহাম্মদ নাসিম (আওয়ামী লীগ নেতা) সাহেবের বিরুদ্ধে। ওখানে আমি শূন্য ভোটে ফেল করছি। আমার ভোটটাও আমি নাসিম সাহেবকে দিয়েছি। যা-ই হোক, এভাবে আমাকে নিষিদ্ধ করেছে, এখন শুধু বিদেশে যাই, গান গাই। করোনাভাইরাস আমাকে একভাবে সহায়তা করছে। ওই সময় করোনাভাইরাস না থাকত আর দেশে অনেক শো হতো আর আমি একদম বসে থাকতাম, তাহলে মনে হয় আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম। করোনাভাইরাসের মধ্যে সব শিল্পীরই গানবাজনা ও চলাফেরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি চিন্তা করেছি, সবারই তো বন্ধ হয়ে গেছে। পরে এখন যখন শো ফিরে আসছে, এত দিনে এসে আমি টের পেলাম, আমি আসলে নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন: এটা আপনার ক্যারিয়ারের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

কনকচাঁপা: রাজনৈতিক প্রভাবে যে বিষয়টা হয়েছে, এটা নিয়ে আমি আসলে ভেঙে পড়ার মানুষ নই। আমার প্রাণশক্তি অনেক বেশি। আমার অনেক ধরনের কাজ আছে, যেগুলো গানের জন্য সারা জীবন করতে পারিনি। সেই কাজগুলো করি।

প্রশ্ন: রেডিও, টিভি, সিনেমা মিলিয়ে আপনার গাওয়া গানের সংখ্যা অগণিত। সঠিক হিসাবটা কি রেখেছেন?

কনকচাঁপা: আমি ডায়েরি ব্যবহার করি। গানের তালিকা সেখানে লিখে রাখি। সেই হিসাবে ৩ হাজার ৬০০ বা ৭০০-এর মতো হবে। এরপরে অবশ্য আরও শ’দুয়েক গান করেছি, কিন্তু সেগুলো ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

প্রশ্ন: আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল কিংবা গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মতো গুণী মানুষেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। সংগীত জগতের এই অভিভাবকশূন্যতা নিয়ে আপনার উপলব্ধি জানতে চাই...

কনকচাঁপা: হারানোর যে বেদনা, এটা সব মানুষেরই থাকে। যাদের নাম বললেন, তাদের প্রত্যেককে বাবা-চাচা-ভাইয়ের মতো সম্মান করেছি, আপন ভেবেছি। ওনারা এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যে, তাদের নামের আগে-পেছনে কোনও উপাধি লাগে না। আমি তো চোখের সামনে দেখেছি, একজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিংবা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যখন কলম ধরেছেন, কোনও কাটাকুটি নেই। মনে হতো, কলম ওই লেখাটা প্রসব করছে! তারা চলে গেছেন ঠিক, কিন্তু সবসময় থাকবেন। তারা যে সম্পদ আমাদের দিয়ে গেছেন, সেটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। একটি সংগীত ইনস্টিটিউট করতে পারি, সেখানে তাদের গান, সুর, কথা এসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হবে; তাদের সৃষ্টি নিয়ে চর্চা হবে। কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার হলো, এই যে গাজী ভাই মারা গেলেন, একদিন পর তাকে দাফন করা হলো। এর আগেই ভুলভাল সুরে তার গান লাইভে গাওয়া শুরু হয়ে গেলো! এতে কি তাকে শ্রদ্ধা জানানো হলো? বরং ওই চ্যানেল কিছু পয়সার জন্য এই কাজ করেছে। বিভিন্ন চ্যানেলে এমন অনেক শিল্পী আসেন, যাদের আসা উচিত না। শিল্পী প্রতিষ্ঠিত কিনা, সেটা বিষয় নয়। আমি চাই, ভুল সুরে যাতে না গায়। ভুলভাবে স্মরণ না হোক। বরং তাদের গান নিয়ে পড়াশোনা করুক এবং শিখুক। এটা আমি জোর দাবি জানাই। 

প্রশ্ন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

কনকচাঁপা: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ, আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।

শেয়ার করুন