২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ৬:৪৯:৫৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


স্পটলাইটে প্রফেসর ইউনূস কীসের ইঙ্গিত?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৮-২০২৩
স্পটলাইটে প্রফেসর ইউনূস কীসের ইঙ্গিত? ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চিঠি


প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে অস্বস্তি নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তাকে নানাভাবে হেয় করার প্রচেষ্টা, যা একেবারেই প্রকাশ্যে, একবার নাম না উচ্চারণ করে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন প্রফেসর ইউনূস এটা বহুল প্রচারিত। কিন্তু এর পক্ষে-বিপক্ষে বহু কথা বাজারে। শান্তিতে এ বাংলাদেশি নোবেল পুরস্কার জয়ী। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি অনেকেই ইউনূসকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। বলেন, ইউনূস বাংলাদেশকে অনেক দেশে চিনিয়েছেন। অনেক তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থীও প্রফেসর ইউনূসের বাংলাদেশকে জানার চেষ্টা করেছেন। 

সেই প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিসফিস। অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে বলেন, কেউ ধারণা করেও বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে, যার প্রধান থাকবেন প্রফেসর ইউনূস। এর সপক্ষে যুক্তি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাজোট বাংলাদেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একযোগে কাজ করে চলেছেন, তাদের খুব কাছের মানুষ, প্রিয়পাত্র বা বন্ধু মানুষ প্রফেসর ইউনূস। স্বাভাবিকভাবেই তারা ইউনূসকে এমন কোনো দায়িত্বে রেখে নিশ্চিন্ত হতে চান। 

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হোক বা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হোক বা প্রধান উপদেষ্টা হোক এগুলোতে আপত্তি নেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলসমূহের। বিএনপি ও বিএনপিপন্থীর বক্তব্য ও দাবি একটাই ক্ষমতাসীন দলের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হবে না। আর যদি তারা সেটা করার চেষ্টা করে, তাহলে সে নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। যদি সেটাই হয়, তাহলে বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ন্যায়। কিন্তু দেশের বিশাল এক রাজনৈতিক দল ও বন্ধুপ্রতিম উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহ সেটা মানবে না। তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে, ভোট হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। যেখানে অংশগ্রহণ থাকবে সব দলের। আর সেটা না হলে ইতিমধ্যে যে ভিসানীতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটার সঙ্গে আরো অনেক পদক্ষেপ নিতে পারেন। 

এদিকে বেশ কিছুদিন থেকেই প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে যে গুঞ্জন চলে আসছিল, সেটা আরো জোরালো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম পরামর্শক বারাক ওবামার এক চিঠিতে। গত রোববার যে চিঠিটা প্রফেসর ইউনূস তার ভেরিফাইড ফেসবুকে আপলোড দিয়েছেন। সেখানে ওবামা ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটা দেওয়া হয়েছে ১৭ আগস্ট তারিখ উল্লেখ করে। 

চিঠিতে ওবামা বলেছেন, “পরিবার ও সম্প্রদায়কে দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থা থেকে তুলে আনার উপায় বাতলে দিয়ে মানুষকে ক্ষমতায়িত করার আপনার যে প্রচেষ্টা, তা আমাকে দীর্ঘসময় ধরে অনুপ্রাণিত করেছে। ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউসে যখন আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল, তখন বলেছিলাম নিজেদের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে আপনার কাজ।”

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, “যাদের সম্ভাবনার বিকাশে আপনি কাজ করেছেন, তাদের অনেকে এবং আমরা যারা সবার জন্য একটি ন্যায়নিষ্ঠ অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তারা সবাই আপনার বিষয়টি ভাবছি। আশা করি, বর্তমান সময়ে এটি আপনাকে শক্তি জোগাবে। আমি আরো আশা করি, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার ক্ষেত্রে আপনি স্বাধীনতা পাবেন।”

ওই চিঠির পর বাংলাদেশেরও দেশের একঝাঁক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের ওই সব বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

রোববার (২৭ আগস্ট) এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘সম্প্রতি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমে তার কয়েকজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে শ্রম আইন ভঙ্গের অভিযোগে শ্রম আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, উত্থাপিত অভিযোগগুলো দেওয়ানি চরিত্রের হলেও সরকারের পক্ষ থেকে ফৌজদারি মামলাটি দায়ের করা হয়। এই মামলা অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা বর্তমানে লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।

ইতিপূর্বে হিসাব তলব, তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে ড. ইউনূসকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়রানি করেছে। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিষোদগার অব্যাহত রয়েছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম আদালতে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের ঘটনাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধারণা করার যুক্তি রয়েছে বলে আমরা মনে করছি। আমরা এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রফেসর ড. ইউনূস অতিদরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের অবস্থার উন্নয়নে কাজ করে বিশ্বে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ও কংগ্রেসনাল গোল্ডমেডেলসহ বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছেন। আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের মোড়কে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তার কর্মযজ্ঞকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং বিশ্বের কাছে নেতিবাচক বার্তা প্রদান করছে।’ 

বিবৃতিদাতা যারা- শিক্ষাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক, মানবাধিকারকর্মী শারমীন মুরশিদ, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক আলী  রীয়াজ, ড. আসিফ নজরুল, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অধ্যাপক সি আর আবরার, অধ্যাপক পারভীন হাসান, অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, মানবাধিকারকর্মী শিরিন হক, নৃতাত্ত্বিক রেহনুমা আহমেদ, গবেষক ড. বিনা ডি কস্টা, অধ্যাপক স্বপন আদনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, রুশাদ ফরিদী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর. রাজী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা খাতুন, ডা. নায়লা জেড খান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, তবারক হোসেইন, পরিবেশবিদ ও উন্নয়নকর্মী এম রেজাউল করিম চৌধুরী, গবেষক ড. সাদাফ নূর, ড. নোভা আহমেদ, রোজীনা বেগম, নাসের বখতিয়ার আহমেদ, লেখক মাহবুব মোর্শেদ ও রাখাল রাহা।

সবশেষ

১৮ মে ২০২২। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, তার কিছু দোসররাও...। এরপরই তিনি বলেন, ‘যিনি একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মত একটি সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকেও আবার পদ্মা নদীতে নিয়ে দুটি চুবানি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসা উচিত। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়। বড় বড় অর্থনীতিবিদ, জ্ঞানী-গুণী তারা এই ধরনের অর্বাচীনের মতো কথা বলে কীভাবে।’

এর আগে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর গ্রামীণ টেলিকমের ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ আরো তিন জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ৯ সেপ্টেম্বর মামলা দায়ের করে। ২০২৩ এর ৮ মে ওই মামলা বাতিলের আবেদন খারিজের বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকমের এই চেয়ারম্যানের লিভ টু আপিলও খারিজ করে দিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে ড. ইউনূস ও আরো তিন জনের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা চলতে থাকে। 

এ বছরেরই গোড়ার দিকে (মার্চে) ড. ইউনূস, “সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার” এ মর্মে একটি চিঠি দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীকে। সেখানে ৪০ জন বিশ্বনেতা খোলাচিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে তারা লিখেছিলেন, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ‘একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশ সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে’। বিষয়টিকে ‘বেদনাদায়ক’ উল্লেখ করে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলাচিঠি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়। ফলে প্রফেসর ইউনূসের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের একটা বিশ্বস্ততা বিদ্যমান। সেখান থেকেই তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

শেয়ার করুন