২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৩:১১:৪৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


দিশেহারা জাতীয় পার্টির নতুন নাটক
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০১-২০২৪
দিশেহারা জাতীয় পার্টির নতুন নাটক


আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া প্রতিশ্রুত ২৬ টি আসন কনফার্ম করতেই নতুন নাটক শুরু করেছে জাতীয় পার্টি। এর পাশাপাশি তাদেরই যেনো সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে নিশ্চিত করা হয়, সে সেব্যাপারে আওয়ামী লীগকে চাপে রাখতে চায়। শেষ মুহূর্তে চাপে রেখে এসব দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে কাবু করতে চায় দলটি। আর এসব কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো পদক্ষেপ নিয়ে নিতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়ে হুংকার দিচ্ছে জাপা। এসব খবর মিলেছে রাজনৈতিক মাঠের বিভিন্ন সূত্র থেকে। 

শুরুতেই জাপা ও জি এম কাদেরের লক্ষ্য 

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের এবারের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ থেকে প্রায় সত্তরটি আসন বাগিয়ে নেবে। আগামী জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে তারাই বসবে সত্তরটি আসন নিয়ে। সেভাবেই অবশ্য জি এম কাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নির্বাচনে রাজিও করানো হয়, প্রতিবেশি দেশের বলা যায় প্রত্যক্ষ আশ্বাসে। কিন্তু মাঠে নেমে দরকাষাকষিতে কৌশলী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তারা মাত্র ২৬ আসনে সমঝোতা করেই শান্ত থাকতে হয়। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন এবং ১৪ দলকে ৬ আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে নানান ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেও জাপা বড়ো ধরনের আসনের ব্যবধানে শক্ত বিরোধী দল হিসাবে থাকার চেষ্টা মাঝ পথেই ব্যর্থ হয়ে যায়। বলা যায় জাপার কৌশলই ভেস্তে যায়। 

নির্বাচনের আগে মাঝে ও পরের বিভিন্ন নাটক

কিন্তু একটি সূত্র জানায়, সত্তরটি আসন পেয়ে বা তার চেয়েও বেশি পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে টার্গেট করে। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের তার পক্ষ্য পূরণে প্রায় দু’বছর আগ থেকে চেষ্টা তদবিরের পাশাপাশি বিপ্লবী ভূমিকায় নামেন। বিপ্লবী ভূমিকার অংশ হিসাবে তিনি মাঝে মাঝেই গর্জে উঠতেন। এক সময় তাকে বলতে শোনা যায় ‘এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’ কিংবা বলতে শোনা যায় ‘প্রহসনের নির্বাচন অংশগ্রহণ করবেন না।’ সরকারের বিরুদ্ধে জিএম কাদের এমপি এ-ও বলেছেন, সরকার শুধু ইয়েস শুনতে চায়। তারা গঠনমূলক সমালোচনাও সহ্য করতে পারে না। তিনি একবার এ-ও বলেছেন, নির্বাচনের আগে আনসার বাহিনীকে পুলিশি ক্ষমতা দেওয়া দূরভিসন্ধিমূলক। সাধারণ মানুষের ধারণা, নির্বাচনে সরকারের প্রভাব আরও বাড়াতেই আনসার ব্যাটালিয়ন বিল-২০২৩ সংসদে তোলা হয়েছে। এই বিলটি পাশ করার চেষ্টা থেকে সরকারকে সরে আসতেও আহবান জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। আবার বলেছেন, নির্বাচনকে এখন ইলেকশন না বলে সিলেকশন বলা যায়। নির্বাচনের নামে যা চলছে তাকে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যায় না।

চাপের কথা নিয়ে নানা গুঞ্জন

এমন সব বক্তব্য দেয়ার একপর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা একটু নড়ে চড়ে বসে। বলা হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাপা’র সাথে একটা খেলায় নামেন। কঠোর হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের ব্যাপারে। দীর্ঘদিন তিনি সে-ই কৌশলে একপ্রকার আটকা পড়ে চুপসে যান। সুর পাল্টিয়ে বলতে থাকেন, আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই আছি। কী হবে, তা এখনো কেউ জানে না। যদি নির্বাচন হয়, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব। যতক্ষণ ঘোষণা না দিয়ে চলে যাব, ততক্ষণ আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছি। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন যদি সঠিকভাবে হয়, তবেই আমরা অংশ নেব। এরই মধ্যে দেশে নির্বাচনী ডামাঢোল বাজলে জাপাকে বিশেষ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের বিভিন্ন ধরনের নাটক করতে দেখা যায়। বিশেষ করে গত বছরে দিল্লিতে তিন দিনের সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি একটু অন্যরকম হয়ে যান। তিনি যে একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন তা স্পষ্ট হয়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে তার একটি বক্তব্য নানান রহস্যের ডাল পালা গজায়। কেননা জিএম কাদের বলেছিলেন, ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে গেছি। সেখানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমার খোলামেলা আলাপ আলোচনা হয়েছে। কার কার সঙ্গে, কী কী বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে- তা আমি বিস্তারিতভাবে বলতে পারব না। কারণ আলাপগুলো ওভাবেই হয়েছে। যদি ওনারা কিছু প্রকাশ করতে চান, তা তাদের বিষয়। তারা করবেন। আমি ওনাদের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। তবে আমরা আমাদের দ্বি-পাক্ষিক, অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। এরপর থেকে জিএম কাদের বলা হয় একটু রহস্যময় ভূমিকা নিয়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণ করতে থাকেন। 

নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে দিনভর নাটকের পর

এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এরপর শুরু হয়ে যায় নানান ধরনের নাটক। এসময়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের এমপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এরপর থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমন আচরণ শুরু করে দেখান যে তিনি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এখনো নির্বাচনে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এই অবস্থায় নির্বাচনে গেলে আমাদের উপর স্যাংশন আসতে পারে। কিন্তু ঘটনার দিন দিনভর নাটকের পর জাপা শেষ মেষ নির্বাচনেই অংশ নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় বিকেল চারটার আধা ঘণ্টা আগে বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক জানান তাদের দল ২৮৩ আসনে নির্বাচন করবে। অথচ এর আগের দিন সকাল থেকেই বনানীতে জাপার চেয়ারম্যানের কার্যালয় ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা ছিল। নেতা-কর্মীদের একটি অংশ ‘দালালি নয়, রাজপথ রাজপথ’, ‘নির্বাচন নয়, বর্জন বর্জন’সহ নানা শ্লোগানে বিক্ষোভও করে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য কার্যালয় ঘিরে অবস্থান নিয়ে নেয় একপর্যায়ে তাঁরা কার্যালয়ের ভেতরে, জাপার চেয়ারম্যানের কক্ষে গিয়ে বসেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন ভূমিকায় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা ধরেই নেয় যে জাপা’র পক্ষ থেকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসতে পারে। কিন্তু শেষ মেষ তা হয়নি। তবে রাজনীতির গুজবের বাজারে প্রচার করা হয় যে জাপা’কে মারাত্মক চাপ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানো হয়েছে। কিন্তু দেশ প্রতিনিধি এব্যাপারে ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে যে জাপা’র কোনো পর্যায়েরই নেতাকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে রাজি করাতে ক্ষমতাসীনরা কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপ দেয়নি। শুধু মাত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি দেখাতে জাপা’র একটি অংশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক চাপের কথা বলা হয়। 

শেষ নতুন নাটকের আসল কারণ

এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর পাচ দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে জাপা’র নতুন নাটক। খোদ দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের হুংকার দিচ্ছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ১ জানুয়ারি সোমবার রংপুর নগরীতে গণসংযোগকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নর জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জিএম কাদের জানান, প্রার্থিতা প্রত্যাহার হুমকির কারণেও হতে পারে, অর্থাভাবেও হতে পারে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার সরে যাওয়াটা ভোটাররা ভালোভাবে দেখেন না, যা রাজনীতির জন্য সুখবর নয়। আবার এক অদ্ভুদ মন্তব্য করেন। তা হলো তিনি আসন ভাগাভাগি প্রসঙ্গে যা বলেছেন গণমাধ্যমে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হয়নি, কোনো মহাজোট হয়নি। এদিকে বরিশালে দুটি আসনের ভোটের লড়াই থেকে সরে গেলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) দুই প্রার্থী। ‘আসন ভাগাভাগির নির্বাচন আখ্যা দিয়ে জাপার প্রার্থীরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি দল ও সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ২০১৮ সালের মতো আরেকটি একপক্ষীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছেন বর্তমান ইসি।’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যাওয়া প্রার্থীরা হলেন, বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) ও বরিশাল-৫ (মহানগর-সদর) আসনের ইকবাল হোসেন তাপস এবং বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনের খলিলুর রহমান। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাপার মোট ১১ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কি জাপা’র নির্বাচন থেকে সরে যাবে? চমক দেখাবে? বিদ্রোহ করে বসবে আওয়ামী লীগের সাথে? এসব ব্যাপারে দলের একটি সূত্র মনে করেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ২৬ আসন পাওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষি করেছে। কিন্তু এই জিএম কাদের সম্প্রতি খবর পাচ্ছেন যে তার দলকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ শেষ মেষ রাখবে না। এবার অন্য ধরনের ফরম্যাটে সংসদে একটি বিরোধী দল দেখা যাবে। সেখানে জাপা গুরুত্ব না-ও পেতে পারে। 

আসলে মাঠে অবস্থানও ভালো না জাপা’র

এদিকে অনেক জোর গলায় দলের নেতারা বলে বেড়ালেও মাঠে জাপা’র প্রার্থীদের বেলায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। জানা গেছে, নির্বাচনে জাপার যে ২৬৫ প্রার্থী অংশ নিয়েছেন তার মধ্যে ১৫০টিরও বেশি আসনে জামানত হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে দলটি। আর জামানাত হারানোর এমন আতঙ্কে বিভিন্ন আসন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন একাধিক প্রার্থী। অনেকে নির্বাচনে মাঠ ছেড়েই ভো-দৌড়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী সমঝোতার অংশ হিসেবে যে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে জাপাকে সেগুলি দলটি ধরে রাখতে পারে কি-না সে ব্যাপারেও সন্দিহান নেতারা। কারণ এসব আসনের বিপরীতে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে। সে হিসাবে জাপা কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বড়ো জোর ১৫ থেকে ২০ টি আসন পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে জাপা’র কি হাল হবে? জিএম কাদেরের রহস্যময় ভূমিকার বা কি হবে? নেতা-কর্মীদের একটি অংশ যারা সেদিন ‘দালালি নয়, রাজপথ রাজপথ’, ‘নির্বাচন নয়, বর্জন বর্জন’সহ নানা স্লোগান দিয়ে জিএম কাদেরকে সর্তক করেছিলেন তাদের রোষানল থেকে কি তিনি রেহাই পাবেন? জাপা কি আসলে আবারো সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে থাকতে পারবে? থাকবেতো জিএম কাদেরের বিরোধীদলীয় উপনেতার পদ? এসব সব নানান চিন্তা আফসোসে পেরেশান হয়ে পড়েছেন জিএম কাদের। এমন অবস্থা থেকেই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের হুঙ্কার দিচ্ছেন এই বলে যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আসলে আওয়ামী লীগের কৌশলে জাপা এখন রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা। বিপাকে পড়েই দিশেহারা। জাপার নেতারা তা-ই এমন সময়ে গরম গরম হুঙ্কার দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া প্রতিশ্রুত ২৬টি আসনই কনফার্ম করতে চাইছেন-এমনটাই রাজনৈতিক বিশ্লষকরা মনে করেন।

শেয়ার করুন