২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০২:৩৬:১৬ পূর্বাহ্ন


গণতন্ত্র প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটার্ন না অন্যকিছু
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০২-২০২৪
গণতন্ত্র প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটার্ন না অন্যকিছু তিন সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল


দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিনী এক ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা গিয়েছিল। যেভাবেই হোক, সেটা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঝড়ের কবলে পড়েনি বাংলাদেশ। যার ফলশ্রুতিতে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। 

গত ১২ ফেব্রুয়ারিতে নওগাঁ-২ আসনে স্থগিত হওয়া সর্বশেষ আসনের নির্বাচনও সম্পন্ন। এরপর সদ্য শেষ হলো সংসদে ৫০ মহিলা আসনের নির্বাচনের পর্বও। সংসদ যখন পরিপূর্ণ ঠিক এমনি মুহূর্তে আবারও সেই ঈষাণ কোণে যেন ঘনকালো মেঘ জমেছে বলেই প্রতিয়মান হচ্ছে। সেই পুরানো চ্যাপ্টার। সেই মার্কিন ঝড়ের পূর্ভাবাস। নতুবা বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচনি প্রক্রিয়া ঠান্ডা মাথায় হজম করে এমন কী হলো যে হঠাৎ তিন সদস্যের গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর। প্রভাবশালী ওই তিন সদস্যের পরিচয়টা পেলে অনেকটাই স্পষ্ট হবে তাদের উদ্দেশ্যসমূহ। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই টিমের নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ সহকারী এবং দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র পরিচালক আইলিন লুবাচার। সঙ্গে ছিলেন দাতব্য সংস্থা ইউএসএআইডি’র এশিয়া বিষয়ক সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার। 

যুক্তরাষ্ট্রের এ শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এমন সময় বাংলাদেশ সফরে এল, যখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার নিরিখে ভূ-রাজনীতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিনিধি দলের সফরকে সরকার সমার্থকরা বিশ্লেষণ করছে তাদের মত করে। সরকারি প্রতিনিধি ও কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরকে ‘নির্বাচন পরবর্তী বোঝাপড়ার’ প্রতিফলন হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাঁরা এই সফরকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করছেন। নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। দুই দেশই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায় বলেই মনে করছেন তারা। 

কিন্তু এ সফরের দলনেতা যিনি, তার কাজের ক্ষেত্রটা নিরাপত্তা জনিত। যা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগ পরের কোনো কার্যক্রম বা বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজের দ্বায়িত্ব পালনের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাইডেনের চিঠি 

একটু পেছনের কথা হলেও সেটাকে এ মুহূর্তে সামনে নিয়ে আসার কারণ মার্কিনীরা সিরিজ বাই সিরিজ যে কাজগুলো করে থাকেন, সেটার ধারাবাহিকতা বোঝানোর জন্যই। এর পরিপেক্ষিতে বাইডেনের লেখা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠির গুরুত্ব অনেক। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বাইডেন তার চিঠিতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উচ্চাভিলাসী অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোতে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য আমাদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এবং আরও অনেক বিষয়ে তাদের কাজ অব্যাহত রাখার আন্তরিক আকাক্সক্ষার কথা জানাতে চান তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, সমস্যা সমাধানে আমাদের একসঙ্গে কাজ করার দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস রয়েছে এবং আমাদের জনগণের সঙ্গে জনগণের শক্তিশালী বন্ধনই এই সম্পর্কের ভিত্তি।’ এখানে একটি বিষয় যেটা নতুনভাবে আগ্রহ দেখিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সেটা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা। সেটাই এখন আলোচ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। 

কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এলিন লুবাচার। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও বিশেষ সহকারী। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের অধীন এনএসসি মূলত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পটভূমিকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে থাকে। 

আরেকটি বিষয় এখানে চিন্তার বিষয় করে রেখেছে, এ প্রতিনিধি দলের সফরকালের এক মুহূর্তে ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে সফরে গেছেন। সিঙ্গাপুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে। পিটার হাসের এ সিঙ্গাপুর যাত্রাও আলোচনার ইস্যুতে পরিণত। কারণ ইতিপূর্বে তিনি সাধারণত শ্রীলঙ্কা, ভারত গেছেন বলে খবর বের হতো। সিঙ্গাপুর ইস্যু প্রথম। যা উচ্চপদস্থ এসকল কর্মকর্তাদের সফরকালেই যখন হলো। যদিও তিনি স্বস্ত্রীক গেছেন এবং ফিরবেন ৩ মার্চ এমন খবরই প্রচারিত হয়েছে। 

প্রেক্ষাপটটা এমনই এক মুহূর্তে যেখানে মাত্র কয়েকদিন আগে মায়ানমার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষায়ক পররাষ্ট্র সহকারী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক করেছিলেন মায়ানমার ইস্যুতে। 

কী বলেছিলেন ডোনাল্ড লু 

ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি)-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ২ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ও পেন্টাগনের অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে ডোনাল্ড লু বলেন, “আমি বাংলাদেশ, সেখানে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বার্মায় অস্থিরতা এই অঞ্চলের জন্য কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছি। এক মিলিয়নেরও বেশি লোকের জন্য ঢাকা যে উদারতা দেখিয়েছে তার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করেছে। অনন্য এই উদারতা দেখার জন্য আমার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কক্সবাজার পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছিল। আমি এসব শরণার্থীকে ঘরে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোর একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছাও প্রত্যক্ষ করেছি।” 

ডোনাল্ড লু জানান, বার্মার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। তার উদ্বেগের কারণ হলো বাংলাদেশ ও ‘সম্ভবত ভারতের জন্যও’ যে শরণার্থী সংকট ও নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে, যা সামনে আরও গভীর হতে পারে। 

দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং এই অঞ্চলে আমাদের অংশীদারদের, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতকে সমর্থন করতে হবে, যাতে তারা তাদের দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা বাড়তে না দিয়ে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে।” 

বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণয়নের বিষয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এই নতুন বিশ্বকে পরিচালনা করছে এমন প্রশ্নের জবাবে লু মালদ্বীপের উদাহরণ টানেন। 

ডোনাল্ড লু আরো বলেন, “এটি এমন জায়গা যেখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অন্যান্য দেশ নিজেদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা করছে। আমরা আরও ভাল প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে জয়লাভ করব! আমার মত হলো চীন তখনই একটি ভাল অংশীদার হবে যখন সেখানে যথার্থ ও সত্যিকারের প্রতিযোগিতা থাকবে।” 

সব মিলিয়ে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয়ী ইস্যুতে মার্কিনীরা এ মুহূর্তে বেশ সরব সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ সফর করা প্রতিনিধিরাও সে সতর্কতা দিয়ে গেছেন যে মায়ানমারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। 

ফলে এ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল কোনো নির্দেশনা দিয়ে গেছেন কি না সেটা অজানা। 

বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ 

মার্কিন এ প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করা হবে, ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারস্পরিক স্বার্থের অগ্রগতির জন্য একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নে আলোচনা করা হবে। এই সফরে তারা যুব সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তি, শ্রমিক সংগঠন এবং মুক্ত ও সেন্সরবিহীন গণমাধ্যমের বিকাশে যারা জড়িত তাদের সাথে দেখা করবেন বলেও জানানো হয়। 

আরও বলা হয়, মানবাধিকারকে সমর্থন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, আন্তর্জাতিক হুমকির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক স্থিতিস্থাপকতাকে এগিয়ে নিতে এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে একত্রে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে এই তিনদিনের সফরে প্রতিনিধিদলের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রী, একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি, বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ হয়।

মার্কিন এ প্রতিনিধি দলের এ সফরের অন্যতম এক লক্ষ্যণীয় একটা দিক ছিল ঢাকায় ব্যস্ততম সফর কাটানো। যেহেতু বাইডেনের চিঠিতে গণতন্ত্রের ইস্যুটাও রয়েছে। এবং পুরানো যে চাওয়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে চাওয়া সেটা এখনও বিদ্যমান এবং সে অবস্থানে যে তারা এখনও রয়েছেন তা ঢাকা সফরে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগে স্পষ্ট হয়ে গেছে। 

রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র বিএনপির সঙ্গে বৈঠক 

ঢাকায় পা রেখেই ওই মার্কিন প্রতিনিধি দল একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক না করাটাকে রহস্যজনকই মনে হয়েছে। তবে ওই বৈঠকে কী হয়েছে সেটা খোলাসা করেনি কোনো পক্ষই। বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছে হ্যাঁ বৈঠক হয়েছে, কিন্তু এ বিষয় কিছুই বলা যাবে না। তবে বিএনপি নেতাদের বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে। টানা চতুর্থবার ক্ষমতার বাইরে থেকে এরপর শীর্ষ নেতৃত্বের কারাভোগের পর সদ্য কারামুক্ত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আমীর খসরু মাহমুদদের বৈঠক শেষে হাস্যোজ্জ্বল থাকার রহস্য কী সেটা খোঁজার চেষ্ঠা করছেন অনেকেই! 

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতারসহ প্রতিনিধিদল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের সাথে ওই বৈঠক করেন ঢাকার গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে। ওই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয় নিয়ে কিছু জানাননি বিএনপি নেতারা। 

সুশীল সমাজের কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ 

একই (শনিবার) দিনে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদল। এদের মধ্যে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান প্রমুখ এ বৈঠকে ছিলেন। এই বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানতে যোগাযোগ করা হয় বৈঠকে যোগ দেওয়া অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু এই বিষয়ে কেউই কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তবে যতদূর জানা গেছে দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে তারা প্রশ্ন করে বিস্তারিত শুনেছেন। উত্তর দেননি কিছুই। 

এ ব্যাপারে মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পাতায় বৈঠকের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, সুস্থ গণতন্ত্র এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয় এবং বাংলাদেশ সরকারকেও তা করার আহ্বান জানানো হয়। 

শ্রমিক নেতার সঙ্গে বৈঠক 

শনিবার একই দিনে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের তিন সদস্যের এই প্রতিনিধি দল। কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, “শ্রম আইনের সংস্কার, গাজীপুরের শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম হত্যা মামলা নিয়ে এ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।” 

এছাড়াও ইউএস ব্রান্ড যারা আছে তারা কীভাবে ব্যবসা করতে পারে এ বিষয়েও কথা হয়েছে বলে জানান কল্পনা। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন 

২৫ ফেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হাছানের সঙ্গে এক ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে বাংলাদেশ সফররত এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর আইলিন লুবাচার। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পত্রের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর লেখা পত্রের একটি কপি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী লবাখারকে হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র। দু’দেশের সম্পর্কে নতুন অধ্যায় শুরু নিয়ে, এই সম্পর্ককে কিভাবে আরও গভীর করা যায়, সে সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। 

বাসস জানিয়েছে, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেছে। তারাও চায় রোহিঙ্গারা সসম্মানে নিজ দেশে ফিরে যাক। সেই সাথে তাদেরকে সাময়িক আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছে মার্কিন প্রতিনিধিরা। 

হাছান মাহমুদ বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধসহ যে কোনো যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছি। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীকে দেশে আনার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তাদের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এটি দেখছে। র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি পর্যবেক্ষণ (অবজারভেশন) দিচ্ছে, যে সব বিষয়ে বাংলাদেশ তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরবে। 

পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, শ্রম পরিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইউএসএইডের সহযোগিতা আলোচনায় স্থান পায়, উল্লেখ করেন মন্ত্রী। সফররত ইউএসএইডের এশিয়া ব্যুরোর এসিস্ট্যান্ট এডমিনিস্ট্রেটর মাইকেল শিফার এবং ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার বৈঠকে অংশ নেন।

এই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। মি. হাছান মাহমুদ বলেন, “তারা তাদের সাথে দেখা করেছে সেগুলো নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। ভবিষ্যতে হয়তো দেখতে পাবেন সব ঘরানার মানুষের সাথে তারা বসবে না।” যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সম্পর্কের উন্নয়নে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। 

সবশেষ

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারও প্রায় দুই বছর আগ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে বেশ সরব ছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। এ জন্য বাংলাদেশের জন্য নতুন করে এক ভিসানীতি প্রণয়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও একই ইস্যুতে এর আগে র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি। এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বহুবার বৈঠক হয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা অনুযায়ি গণতন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। কিন্তু এর ছিটেফোটারও বাস্তবায়ন হয়নি বাংলাদেশে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে অনেকটাই এক তরফা। যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সেই দলের কতিপয়কে স্বতন্ত্র প্রার্থী বানিয়ে অনেক আসনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণকরণ হয়েছে। এ নির্বাচনে ৪২% ভোট কাউন্ট হয়েছে বলে জানান দেয়া হয়। তবে নির্বাচনের পরপরই ভারত এ ভোটকে সমার্থন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতিতে বলে এ নির্বাচন হয়নি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। এরপরই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওই চিঠি। 

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আবারও সেই আগের স্থানেই রয়ে গেছে বলে অভিমত। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন কী করবে সেটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ, আলোচনা। তাছাড়া ইন্দো প্যাসেফিকেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আগ্রহ। যেখানে বাংলাদেশকে সূচনা থেকে চেয়ে আসছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সে চাওয়ায় সাড়া দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড অন্যদেশ আক্রমণ করার জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এ দৃঢ়তা অদ্যবধি। সর্বশেষ, গত ১৩ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি, স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি আরও বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত। এক হচ্ছে খুনি বা অপরাধী, যুদ্ধাপরাধী; যাদের বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে, তারা ষড়যন্ত্র করছে। আরেকটি আন্তর্জাতিক স্তরের।’ শেখ হাসিনা বলেন, অন্যান্য কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ওপর অনেক দেশের কুদৃষ্টি রয়েছে। তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশে বসে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে তিনি কাউকে অনুমতি দেবেন না এবং মেনে নেবেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ, আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করব, আমরা আকারে ছোট হতে পারি, কিন্তু আমাদের বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে, তারাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’

সব মিলিয়ে সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদচারণা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশের মানুষ, কোন বাঁকে পা রাখবেন তারা পূর্বের অবস্থানে না নতুন সরকারের সঙ্গেই...। তাছাড়া দেশটির আসল চাওয়াই বা কী। সরকারের অবস্থানই বা এ ক্ষেত্রে কী হবে এমন আলোচনা এখন সর্বত্র। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে তারা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা বলেছেন। যা তাদের দূতাবাস সাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।

শেয়ার করুন