২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৫:৬:২১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর ঢাকা মহানগরী
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৩-২০২৪
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর ঢাকা মহানগরী বঙ্গবাজারে আগুন


ঢাকার অভিজাত এলাকা বেইলি রোডে একটি ভবনে সম্প্রতি প্রাণঘাতী অগ্নিকা-ের পর দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে বিভিন্ন সংস্থা। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্য সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে চালাচ্ছে অভিযান। রাজউক অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটানো অনেক ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সিলগালা করে বন্ধ করা হচ্ছে। অনেক ভবন এবং ব্যবসা মালিকদের জরিমানা করা হচ্ছে, বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা চলছেই। যেমনটা হাতির ঝিল এবং গুলশানে দুটি ভবনে আগুন ধরেছে। অংশীজন অনেকের ধারণা হাজারো ছিন্ন গ্যাস বিতরণ লাইন থাকায় ঢাকা মহানগরী এবং আশপাশের শহরতলি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে, অবৈধভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে অনুমোদনহীন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থাকায় ঢাকার অনেক ভবন এখন জীবন্ত বোমা। অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো স্বাভাবিক পরিণতিতে যে সংস্থাগুলো এখন তৎপরতা দেখাচ্ছে, সেগুলো যথারীতি সক্রিয় থাকলে এগুলো সীমিত করা যেতো, এমনকি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। 

কেন আগুন লাগছে? 

দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুনের উৎপত্তি হয় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে, গ্যাস পাইপলাইন লিকেজ থেকে আবদ্ধ ঘরে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে, সিএনজি অথবা এলপিজি অনিরাপদভাবে ব্যবহারের কারণে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিষয়গুলো দেখার সুনির্দিষ্ট একাধিক সংস্থা আছে। দেশে আইন আছে, আইনপ্রয়োগ করার নির্দিষ্ট সংস্থা আছে। কিন্তু কোনো সমন্বয় নেই, কারো কোনো জবাবদিহিতা সেই। আর তাই রেস্টুরেন্টে আগুন ধরে মানুষ পুড়ে মরছে, মসজিদে রোজার সময় নামাজে আসা মুসল্লিরা পুড়ে মারা যাচ্ছে। পুরোনো ঢাকায় রাসায়নিক গুদামে আগুন ধরে পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরে আগুনে পুড়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। অপমত্যুর মিছিল চলছেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু কোথাও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। 

এবারে বেলি রোডে প্রাণঘাতী অগ্নিদুর্ঘটনার পর জানা গেল ভবনটির রাজউক অনুমোদন অনুযায়ী ব্যবসায়ী কাজে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। অথচ ভবনে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ফায়ার সার্ভিস থেকে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হলেও পরবর্তী কোনো ফলোআপ কেউ করেনি। শুধু এই ভবন নয় দেখা যাচ্ছে, ঢাকার অনেক বহুতল ভবনে একই ধরনের অনেক রেস্টুরেন্ট অবৈধভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে। এই ভবনগুলোতে না আছে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, না আছে দুর্ঘটনার সময় ব্যবহারের দ্রুত বের হওয়ার পথ। তাই এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড অপরিহার্য পরিণতি। 

ঢাকা কিন্তু আকারে পরিসরে এখন মহানগরী। ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ এমনকি অনেকের মতে তিনগুণ জনবসতি ঢাকা মহানগরীতে। পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে ওঠা ইটপাথরের বস্তি ঢাকা শহরে যানজট, শব্দজট, বায়ুদূষণ, জলজট নিত্যসঙ্গী, সড়কে নিয়ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটছে। এর সঙ্গে যোগ করুন অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু। এক সময়ের তিলোত্তমা ঢাকাকে অনেকে এখন বসবাসের জন্য অন্যতম নিকৃষ্ট শহর বলে চিহ্নিত করে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। অবিলম্বে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বিবেচনা করে কিছু উপমধর্মী ব্যবস্থা গৃহীত না হলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। 

প্রয়োজন মেট্রোপলিটন গভর্নেন্স 

ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন, জনসেবা, জনসুরক্ষার জন্য অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। রাজউক, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। প্রতিটি সংস্থা নির্দিষ্ট পরিসরে কাজ করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় নেই। কেউ যেন কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। ঢাকা মহানগরীকে দুটি সিটি কাউন্সিল আছে। আছেন দুইজন মেয়র। বর্তমান অবস্থার বিবেচনায় ঢাকা মহানগরীর সব উন্নয়নকাজ, পরিষেবাসমূহ সমন্বয়ের দায়িত্ব দুই মেয়রের কার্যালয়ে অর্পণের বিষয় জরুরিভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পার্লামেন্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে মেট্রোপলিটন গভর্নেন্স সৃষ্টি করতে হবে। সব সংস্থা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু মেয়র অফিস সমন্বয় করবে সব কাজ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, অন্যান্য অংশীজন মেয়র অফিসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দায়িত্ব পালন করবে। 

ঢাকায় অনুমোদনহীন, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো অবিলম্বে ভেঙে ফেলতে হবে। আবাসিক স্থাপনায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস থেকে যে সমস্ত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে সেগুলো হয় ভেঙে ফেলতে হবে না হয় সংস্কার করতে হবে। পুরান ঢাকা এবং সংকীর্ণ সড়ক পাশে, অলিগলিতে গ্যাসলাইনে অসংখ্য ছিদ্র আছে। এগুলো চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। রান্নার জন্য পাইপলাইন গ্যাস ব্যবহার পর্যায়ক্রমে রোহিত করতে হবে। 

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এলপিজি ব্যবহার অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। অসাধু চক্র নিম্নমানের রেগুলেটর, হোজ পাইপ ব্যবহার করছে, এলপিজি সিলিন্ডার পরিবহন এবং সংরক্ষণ কাজে নিরাপত্তা বিধিমালা মানা হচ্ছে না। এগুলো যাদের তদারকি করার কথা তারা কিছুই করছে না। জনসচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। বহুতল ভবনগুলোতে বাধ্যবদকতামূলকভাবে রেটিকুলেশন সিস্টেম চালু করা জরুরি এখন। এলপিজি রেগুলেটর এবং হোজ পাইপের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে এগুলো ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত নিরাপদ ব্যবহার বিধি জনগণকে জানাতে হবে। 

সবচেয়ে বড় কথা জনসচেতনতা। দেশের মানুষ সচেতন হলে দুর্নীতিবাজ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কবল থেকে ঢাকাকে নিরাপদ করা অসম্ভব কিছু না। দুনিয়ার বহু শহর ঢাকার মতো জনগোষ্ঠী নিয়েও নিরাপদে আছে।

শেয়ার করুন