২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০১:২৫:০০ অপরাহ্ন


ঢাকা কলেজে শিক্ষাজীবনের চির তরুণদের মিলনমেলা
ঢাকা কলেজের ’৮৫ ব্যাচের পুনর্মিলনী
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৬-২০২২
ঢাকা কলেজের ’৮৫ ব্যাচের পুনর্মিলনী পুনর্মিলনীতে ঢাকা কলেজের ৮৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা


কি রে ভুইল্যা গেলি সব? তোরে কলেজ কেন্টিনের সামনে কইষ্যা মাইর দিছিলাম। বাচ্চা পোলাগো মতো সেদিন কান্নাকাটি করছিলি? আহা রে এখনো কানে ভাসে, মনে পড়ে তোর কান্দনের আওয়াজ। কলেজ জীবনের এক বন্ধু আরেকজনকে দীর্ঘদিন পর কাছে পেয়ে মনে করিয়ে দিলো পুরোনো সেই দিনের কথা। সব শুনে যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, যে বন্ধু উত্তর দিলো না রে মনে নেই। এই বন্ধু পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকেই বললো, কিন্তু তোর কি মনে আছে আমারে তুই সব সময় ঘুম থেকে উঠাইয়া দিতি ক্লাসে যাওনের আগে? আরোকি মনে পড়ে তোর, কলেজের হোস্টেলে একরুমে থাকা, খাওয়া-দাওয়া আর সময় পেলেই নিউমার্কেট থেকে ইডেন কলেজের আশপাশে অযথাই ঘোরাঘুরি।না রে, আমার তো তা মনে পড়ে না, অবাক চোখে তাকিয়ে সেই বন্ধু অপরজনকে বললো, তাই নাকি?

তাহলে কি হলো? মনে আছে সব কথা? তোরও মনে নেই আমারো নেই। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়েই বললো। আর এমন স্মৃৃতি মনে করে দু’জনের মাঝে আরেক বন্ধু বললো- এসব সোনালি অতীত কি আর ফিরে আসবে না রে? কেন আসবে না?এই তো এলো? চারিদিকে মেঘ চোখ রাঙাচ্ছে? বৃষ্টি কেমন জানি সবাইকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে আর অন্যদিক ঘরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (অনেকে নিজ স্ত্রীকে জোক করে এই নামে অভিহিত করে) ধমক? তারপরেও কি আমরা আইছি না?’ আইয়া পরি নাই?  এদের আলোচনা লাফ মেরে ঢুকে পড়েই এসব কথা বললো আরেক বন্ধু। 

ঢাকা কলেজে শিক্ষাজীবনের এমন আলোচনায় জমে উঠেছিল সেদিন রাজধানীর পিলখানায় শপিংমল সীমান্ত সম্ভারেরইএই ব্যাঙ্কুয়েট হলে। বিশাল পরিসরে মাত্র পাঁচঘণ্টায় পুরো হল দাবড়িয়ে বেড়ায় ঢাকা কলেজ থেকে পাস করা এসব মধ্য বয়সের প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা, যাদের হৈ-হুল্লোড় আর ফুর্তি দেখে আশপাশে সবাই বলাবলি করছিল যেন চির তরুণদের মিলনমেলা। 

১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তারিখে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যাত্রালগ্ন থেকেই পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ায় এখন পর্যন্ত ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর এ কলেজেরই ’৮৫ব্যাচের প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা, যারা নিজেদের ডিসি কেইভ-৮৫ বলে সম্বোধন করে, তারাই গত ১৭ জুন রাজধানীর পিলখানাস্থ সীমান্ত সম্ভারেরইএই ব্যাঙ্কুয়েট হলে আড্ডায় নিজেদের হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। যাদের মনে আকুতি ছিল ফিরে যেতে চাই সোনালি অতীতে। এবার এর পুরো অনুষ্ঠানেরই আয়োজক ছিল ’৮৫ ব্যাচের বন্ধুদের মধ্যে ফারুক ও তাসলিম। দু’জনে বন্ধুদের এমন মিলনমেলায় অকুণ্ঠ সমর্থ দেয়। আর এসব কিছুর আয়োজন হয় আরেক বন্ধু জকি আহাদের চাকরি জীবনে বিদেশে পোস্টিং হওয়াকে উপলক্ষ করে। 

চলে সেলফির প্রতিযোগিতা

ডিজিটাল যুগে একটা বড় জিনিস হলো কেউ বাদ যাবে না। আর এসুযোগ নিতে কোনো বন্ধু ক্যামেরাকে সেলফি মুড সেট করা মাত্রই সব যেন কি হচ্ছে রে? আমিই কি বাদ যাবো, তা হবে না তা হবে বলেই ঝাঁপিয়ে পড়া। সেদিন এমন সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা ছিল দেখার মতো। কেউ চিত হয়ে, কাউকে মাথা উঁকি দিয়ে আবার কারো মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়েই একেকজনের তোলা সেলফিতে ঢুকে পড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। বাইরে ছিল তখন তুমুল মেঘের গর্জন আর বৃষ্টির চোখ রাঙানি, যা পাত্তাই দেয়নি এসব মধ্যবয়সী তরুণরা। অথচ এই বয়সে এখন কেউ হয়েছেনশিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার। অনেকে আসীন হয়েছেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তা হিসেবে। কেউ নাম লিখিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বিশিষ্টব্যবসায়ী-শিল্পপতির কাতারে। কিন্তু জীবনের এই মধ্যবয়সেও পুরো নৈশভোজ ও পুনর্মিলনে বন্ধুদের শারীরিক-মানসিক চঞ্চলতা সকলকে বিমোহিত করেছে। 

গ্রুপ ছবি তুললে হুড়মুড় করে পড়া

সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটে অনুষ্ঠানের একফাঁকে যখন ঘোষণা দেয়া হয়, একটা গ্রুপ ছবি তোলা হবে, বন্ধুরা সবাই চলে আসো। আর কে কারে পায়? হুড়মুড় করে সব ছুটে আসে স্টেজে। যেখানে ছিল জমকালো আয়োজনের চোখ ঝলসানো ব্যানার। আর এ ব্যানারে লেখা আছে ‘বন্ধু ছাড়া লাইফ ইমপসিবল’।

কিন্তু এই স্টেজে সবাই উঠে গ্রুপ ছবি তুললে তো এটি ভেঙে পড়বে। আর তাই ব্যানারকে পিছনে রেখে স্টেজে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তোলার পরিকল্পায়ও ছেদ পড়ে। বলা হয় স্টেজ থেকে নেমে ব্যানার পেছনে রেখে গ্রুপ ছবি তুলতে হবে। আর পায় কে কারে আবারো হৈ-হুল্লোড়। আর শুরু হয় সবাই যেন একই ফ্রেমে বন্দি হয় তার প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতা। কেউ-ই যেন বাদ না পড়ে তার প্রচেষ্টা। আর সেটাই হলো। কেউ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো? কেউ ক্যামেরার সামনে আঙুল উঁচিয়ে জানান দিলো আমিও আছি? কেউ অতিরিক্ত লম্বা বলে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে মাথাটা একটু বের করে জানান দিলো, আমি আছি তো রে? বাদ যায়নি তো?

আর কোনো কৌশলেই যখন ক্যামেরায় বন্দি হওয়া যাচ্ছে না এমন বন্ধুদের কয়েকজন চিৎপটাং। যেন অভিমানে মাটিতে শুয়ে পড়া আরকি। কিন্তু কেন এমন করছে এমন বয়সের তরুণরা, কিছুই না। এই মধ্যবয়সের জানান দেয়া আমরা দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া তরুণরা আবারো সোনালি অতীতে ফিরে যেতে চাই। আর এজন্যই ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে সেদিন হাজির হওয়া সীমান্ত সম্ভারের ইএই ব্যাঙ্কুয়েট হলে। আর এর পাশাপাশি এতোটুকু জানান দেয়া যে, বন্ধুত্ব মানে বোঝাপড়া, কোনো চুক্তি নয়। বন্ধুত্ব মানে ক্ষমা করা, ভুলে যাওয়া নয়।


শেয়ার করুন