২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৬:৪৯:৫৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


রাজনীতির ‘স্পটলাইটে’ পিটার হাস
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৬-২০২৩
রাজনীতির ‘স্পটলাইটে’ পিটার হাস ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস


হঠাৎই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বলা যায়, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির স্পটলাইট পিটার হাসের ওপর। প্রতিনিয়ত তার সঙ্গে দেখা করছেন, যোগাযোগ রাখছেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ তিন দলের প্রতিনিধি হিসেবে পর্যায়ক্রমেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনা করেন। বৈঠকের বিষয়বস্তুর কিছুটা প্রকাশ পেলেও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয় না। তবে প্রতিটা বৈঠক হয় বেশ সময় নিয়ে। এসব বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ। বিশ্লেষকদের অভিমতের উদ্দেশ্য, মার্কিন অনুকম্পা লাভের তাগিদ থেকে। 

কয়দিন আগেও বিএনপি নেতৃবৃন্দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে বৈঠককে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছে। বিএনপি বিদেশিদের কাছে নালিশ করছে। বিএনপির অর্থ বাংলাদেশ নালিশ পার্টি। এখন সে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সাক্ষাৎ করছেন পিটার হাসের সঙ্গে। অবশ্য এর পেছনে উসিলা দিচ্ছেন। কিন্তু মূলে যে ধারণাটা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেটা ক্ষমতা। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমর্থন।  

ঢাকায় পা রাখার পর থেকে পিটার হাস বিভিন্ন স্থানে গমন করেছেন। এটা অনেকের কাছেই ভালো ঠেকেনি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কিছুটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যও ছিল। এটা সাংবাদিকদের কাছেও প্রকাশ করা হয়েছিল। যেমন গত ১৪ জুন সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায় যে চারটি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতকে পুলিশের এসকর্ট দেওয়া হয়, সেটা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের। গত ১৪ মে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা তথা, সার্বক্ষণিক পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঘটনাটি প্রকাশের পর থেকে কূটনৈতিক পাড়ায় রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। রাষ্ট্রদূতদের এসকর্ট সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, কেবল এসকর্ট প্রত্যাহারই নয়, রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে ফ্লাগ উড়ানো বন্ধের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। মন্ত্রী বলেন,  নিরাপত্তার নামে চার-পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূত বাড়তি ঢং করছিলেন। নিউইয়র্কে ১৯৩টি দেশের স্থায়ী মিশন রয়েছে। সেখানে যেসব মিশন প্রধান দায়িত্ব পালন করেন, তাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশের কেবিনেট মেম্বার পদমর্যাদার। কিন্তু ওখানে কেউ পুলিশ এসকর্ট নিয়ে চলার চিন্তাও করতে পারেন না, গাড়িতে পতাকা উড়ান না। ড. মোমেন  বলেন, আমি মন্ত্রী, কিন্তু কোথাও পুলিশ এসকর্ট নেই না। এমনকি মফস্বলে গেলেও না। কারণ আমি মনে করি, এটি একটি বাড়তি ঝামেলা। বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে কিংবা শপিংমলে আক্রমণ করে লোক মারে না। সুতরাং চলাফেরায়  কোনো অসুবিধা নেই। 

সরকারি ওই সিদ্ধান্তের পর পিটার হাস এক অনুষ্ঠানে তার গাড়িতে পতাকা না উড়িয়ে যোগ দেন এবং ওই অনুষ্ঠানে সারাক্ষণই চুপচাপ ছিলেন। কোনো কথা তিনি বলেননি। পরে চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানেও তিনি যাননি। এর আগে শাহীনবাগে ঘুম হওয়া এক ব্যক্তির বাড়িতে যাওয়া নিয়েও তোলপাড় হয়। পিটার হাস সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে তিনি অবরুদ্ধ হয়েছিলেন-এমন এক অভিযোগ নিয়ে তিনি সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে যান। অভিযোগ তোলেন। সেটা নিয়েও তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অনেক কথা বলা হয় তাকে।

সর্বশেষ, গত ৫ জুন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, কোনো বিদেশি কূটনীতিক বাংলাদেশে কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি কয়েক জন কূটনীতিকের বিএনপি কার্যালয়ে গমনের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

কূটনীতিবিদদের কিছু রুলস রেগুলেশন রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের ইনভেস্টমেন্ট ও বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে তারাও জড়িত। ফলে বাংলাদেশে একটি সুস্থধারার রাজনীতি দেখার প্রতীক্ষা তাদের। এ ব্যাপারে তাদের নিজ দেশে অনেক আপডেট দিতে হয়, বিশেষ করে দেশের গণতন্ত্রের বিষয় নিয়ে। বাংলাদেশে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে রাজ্যের অভিযোগ। ফলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনও যাতে অনুরূপ না হয়, সেজন্য কূটনীতিকরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করে আসছে। ফলে তারা এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলছেন যেমনটা ইসি, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন সরকারি দল ও প্রশাসনের ব্যক্তিদের সঙ্গে। এ কাজগুলো তাদের দৃষ্টিতে যৌক্তিক বলেই তারা মনে করে আসছে। 

এটা ঠিক বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ওলটপালট করে দেয়। বিশেষ করে ভিসানীতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সেক্রেটারির টুইট। যেখানে জানানো হয়, ৩ মে এ ভিসানীতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়। 

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে এসব ঘটনা কী ওই ভিসানীতির প্রভাবেই। যদি সেটাই হয়, তাহলে সে সময় একধরনের কথা। এরপর ব্লিঙ্কেনের টুইটের পর আবার কেন সব চুপচাপ এবং পিটার হাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্থিরতা সবার মধ্যে। এ জন্য এক প্রতিযোগিতা। কেননা ভিসানীতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মুখপাত্ররা বলছেন, এটা বিএনপির জন্য। আবার বিএনপি বলছে এটা কলঙ্কের। যা স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেয়নি কেউ। এবার এ সরকারের আমলে এলো। এটা লজ্জার। 

ভিসানীতির পরই বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করেন পিটার হাসের সঙ্গে। এরপর পর্যায়ক্রমে সাক্ষাৎ চলছেই। সর্বশেষ গত ৪ জুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদের সাক্ষাৎ করেন পিটার হাসের সঙ্গে। 

এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করে আসেন। এর আগে পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা-প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সরকারি অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এরপর আনিসুল হক বলেছেন, তাদের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বক্তব্য ছিল। সেসব বিষয় নিয়েই রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়েছেন এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। এর বাইরে আইনমন্ত্রী ওই বৈঠক সম্পর্কে আর কিছু বলেননি। 

তবে মির্জা ফখরুল তার বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, সে ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সরকার যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়াসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে এ ভিসানীতি দিতে হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের এ অবস্থানই পিটার হাসের কাছে তুলে ধরেছি। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বিএনপির বক্তব্য জানতে চান বলে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন। 

পরিশেষে: 

ভিসানীতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সাধারণ নেতাকর্মীদের এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা না থাকলেও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। যাদের বেশির ভাগের গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে। যেখানে ফ্যামিলি তথা, স্ত্রী সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন এদের অনেকের। এমন ভিসানীতিতে প্রশাসনের সঙ্গে কোনো রকম চিহ্নিত হলে তাদের দীর্ঘদিনের লালায়িত স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। সমস্যার মূল সেখানেই। কারণ পূর্বেও যারা অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন বলে প্রমাণ রয়েছে তাদের জন্যও ওই ভিসানীতির খড়গ। টেনশন তো সর্বত্রই! ফলে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে একধরনের বন্ধনা পিটার হাসের কাছে। যেন সবকিছু পেছনে ঠেলে পিটার হাসকে খুশি রাখতে পারলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুশি ও সহায় থাকবেনÑভাবখানা এমন!  

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পরিচালনায় যারাই দায়িত্বে ছিলেন বিভিন্ন সেক্টরে, তাদের অনেকেরই এক পা আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপে। সুযোগ বুঝে মজা লুটে পাড়ি জমাতেন তারা ওই সব দেশে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কী পেলো, কী পেলো না তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানোর চিন্তাও তাদের ছিল না। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে সেসব সাধারণ মানুষের পাশে। বলছেন, তারা ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন এবং নেতা নির্বাচনে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বের করে নেওয়ার ক্ষমতা তারা (আমেরিকা) জনগণের হাতে দিয়ে ছাড়বেন, তার আগে নয়। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাটাও ঠিক অমন। রাজনীতিবিদরা যা পারেনি, মার্কিনিরা যদি সেটা করে দিতে পারেন, তাতে কিছুটা লজ্জা থাকলেও তো দোষের কিছু নেই, বরং জনগণ বেজায় খুশি।

শেয়ার করুন