যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সী রাজ্যে বসবাসকারী সাবেক ছাত্রনেতা, বিশিষ্ট সংগঠন, রাজনীতিবিদ, কম্যুনিটির অতিপরিচিত মুখ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান সালু আর নেই (ইন্না লিল্লাহি.. রাজেউন)। গত ৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে নিউজার্সীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা, নাতি, বহু আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী-ভক্ত রেখে গেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। আতিকুর রহমান সালুর প্রথম নামাজে জানাজা গত ৫ ডিসেম্বর বাদ মাগরিব জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। তার জানাজায় কম্যুনিটির সর্বস্তরের লোকজন অংশগ্রহণ করেন। ৬ ডিসেম্বর নিউজার্সিতে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে নিউজার্সিতে মুসলিম গোরস্তানে দাফন করা হবে।
আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান ও ফোবানা’র সাবেক চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান সালুর চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে তার মারণব্যাধী ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তার চিকিৎসা চলছিলো এবং তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মতি কেমো নিচ্ছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে গত ৩০ নভেম্বর শনিবার তাকে নিউজার্সীর প্যাসিক সিটির একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মূলত: তিনি লাইফ সাপোর্টেই ছিলেন। মঙ্গলবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাফফেরাত কামনায় পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসী ও সকল প্রবাসী বাংলাদেশীর দোয়া কামনা করা হয়েছে।
আতিকুর রহমান সালু’র পরিচিতি
জন্ম টাঙ্গাইলে ১৯৪৮ সনে। শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে দূরন্তপনায়। হাই স্কুলের শেষ প্রান্তে নিউ ক্লাশ টেনে পড়াকালে সমগ্র হাই স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেন এবং পরবর্তীকালে মধ্য ষাট দশকে টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী করটিয়া কলেজ (বর্তমানে সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) ছাত্র সংসদের এজিএস এবং সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও পরবর্তীতে আইনে ডিগ্রি লাভ। এর মাঝে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সনের টাঙ্গাইলের প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনে তথা ঢাকাসহ তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তনে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান ও কারাবরণ। ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন টাঙ্গাইল মহুকুমা-তথা টাঙ্গাইল জেলার সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি পদ ও পরবর্তীকালে অভিবক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে সংগঠনের (মেনন গ্রুপ) সাংগঠনিক সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন তথা বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। এখানে উল্লেখ্য, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের মূল স্লোগান ছিলো ‘মেহনতী জনতার সাথে একাত্ত হও’, এই মূলমত্রে দিক্ষিত হয়ে আতিকুর রহমান সালু শ্রমিক রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। এক সময় তিনি তৎকালীন টাঙ্গাই মহুকুমা প্রেস কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ১৯৬৯ সনের ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় কখনো কখনো করেছেন প্রতিনিধিত্ব। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে, ১৯৬৯ এর সুমহান গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ছিলেন অন্যতম সংগঠক। মূলত কবি সালু ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মী। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা।
১৯৭০ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত লক্ষ লোকের সমাবেশে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের প্রস্তাব হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান সালু। অনেক আত্মত্যাগ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশ, আমাদের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ সময়ে ভারতে অন্তরীণ মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে যে কমিটি গঠিত হয় তিনি ছিলেন সেই কমিটিরও কেন্দ্রীয় সদস্য। বিভিন্ন সময় পট পরিবর্তনের হাওয়াতেও আতিকুর রহমান সালু আদর্শচ্যুত হননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও ফারাক্কা লং মার্চের মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্যে থেকে দেশ ও জনগণের জন্যে নির্লোভভাবে কাজ করে গেছেন। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৫ সালের ৪ঠা মার্চ আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির উদ্যোগে উজানে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ও আমাদের নদী পানির অধিকার রক্ষা ও আদায়ের জন্য কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অনুষ্ঠিত লং মার্চেও অন্যদের সাথে নিয়ে নেতৃত্ব প্রদান করেন, যেখানে ৫ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। তিনি আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
আতিকুর রহমান সালু দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এক দিকে কবি, গীতিকার, সুরকার, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ’৬০ দশক থেকে সমানতালে চলছে তার নিরব কাব্য চর্চা। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আনিকার জন্য কবিতা’। আনিকা ছিলো আতিকুর রহমান সালুর ছোট মেয়ে। ২০০৬ সালের ৩০ মে আমেরিকার ভার্জেনিয়ায় এক গাড়ী দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে সফল অস্ত্রপচার পরবর্তীকালে মৃত্যুবরণ করে ১৬ বছর বয়সের আনিকা ৩১ জুলাই ২০০৬ শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ‘অন্য রকম কবিতা’ জনাব সালুর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
এ ছাড়াও প্রবাসের ফোবানাসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জাড়িত ছিলেন। তিনি মাওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশনের সাথেও জড়িত ছিলেন। তার মৃত্যুতে পুরো বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। আতিকুর রহমান সালুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভাসানী ফাউন্ডেশনের সভাপতি আলী ইমাম শিকদার, সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের, দেশ পত্রিকার প্রকাশক মঞ্জুর হোসেন, সম্পাদক মিজানুর রহমান, শাহ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট শাহ জে. চৌধুরী, রাজনীতিবিদ গিয়াস আহমেদ প্রমুখ।