২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০১:১৭:০৭ অপরাহ্ন


মারাত্মক জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন সংস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০১-২০২৪
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন সংস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত


সরকারের অদূরদর্শী পরিকল্পনা, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা নিয়ন্ত্রিত বাস্তবায়ন কৌশল এবং এর সঙ্গে নানা বৈষয়িক পরিস্থিতির সমহারে বাংলাদেশ এখন গভীর অর্থনৈতিক সংকট আর মারাত্মক জ্বালানি ঝুঁকিতে। ডলার সংকট, দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি, সিন্ডিকেটের কুপ্রভাবে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, বিত্তশালীদের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ায় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ট্যাক্স অর্জনে ব্যর্থতা অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে নানাভাবে ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে অর্থ লুণ্ঠন করে বিদেশে অর্থপাচার সংকটকে ঘনীভূত করেছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন সংস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে ভ্রান্ত জ্বালানি কৌশলের কারণে মাটির নিচে আবিষ্কৃত উঁচুমানের কয়লা সম্পদ, জলে-স্থলে সম্ভাব্য বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম সম্পদ আহরণ উপেক্ষা করে অশুভ প্রভাবে জ্বালানি আমদানির আত্মঘাতী কৌশল নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা জ্বালানি ব্যবস্থাপনার। তিন টার্মে ১৫ বছর একাধারে ক্ষমতায় থেকেও কয়লা উত্তোলন কৌশল নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। গ্যাস উত্তোলনে স্থলভাগে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স নির্ভরতা ব্যর্থ হয়েছে। সাগরসীমা জয়ের চটকদার স্লোগান দেওয়া হলেও সাগর থেকে কোনো সম্পদ আহরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ভুল নীতির কারণে বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা, বিপিসির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। সরকার নতুন টার্মে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনলেও জ্বালানি খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কোনো পরিবর্তন আনেনি। 

অথচ আওয়ামী সরকার ১৯৯৬-২০০১ টার্মে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের সুসমন্বিত উন্নয়ন করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিল। পেট্রোবাংলা বিবিয়ানা, সাঙ্গু, জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার উন্নয়ন করেছিল। পদ্মা যমুনার পূর্বপাড়ে গ্যাস সঞ্চালন গ্রিড গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা যমুনার পশ্চিম পাড়ে সম্প্রসারিত করেছিল। সালদা, মেঘনা গ্যাসক্ষেত্র জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত করেছিল। বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে বিদ্যুৎ খাতে আইপিপি, এসআই পিপি, বার্জ মাউন্টেড পাওয়ার প্ল্যান্ট গড়ে তুলেছিল। ২০০১-২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি সরকারের শাসনামলে না বিদ্যুৎ, না জ্বালানি-কোনো সেক্টরেই উন্নয়ন হয়নি। ভেঙে পড়ে জ্বালানি নিরাপত্তা। ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীনতা ছিল ২০০৬-২০০৮ সময়কাল। ২০০৯-২০২৪ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু পাশাপাশি জ্বালানি ক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে জ্বালানি বিদ্যুৎখাত এখন গভীর সংকটে। দেশ জুড়ে গ্যাস বিতরণ এলাকায় মারাত্মক গ্যাস সংকট। গ্যাসের অভাবে বিপুল পরিমাণ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে রয়েছে। অর্থাভাবে বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি কেনার সামর্থ সীমিত থাকায় আসন্ন সেচ মৌসুম, রোজা এবং গরমের সময় বিদ্যুৎ সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ সংকটে ধুঁকছে শিল্পখাত। রফতানিমুখী শিল্পকারখানা কোনোমতে সামাল দিলেও ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পগুলো ব্যাপক সংকটে। বিদ্যমান অবস্থায় ২০২৪-২০২৫ সালে গ্যাস সংকট উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখছে না বিশেষজ্ঞরা। 

গ্যাস জ্বালানি খাতের লেজেগোবরে অবস্থার জন্য সরকারের ভ্রান্ত কৌশলকে দায়ী করছে সবাই। কেন, কাদের স্বার্থে বিপুল পরিমাণ আবিষ্কৃত কয়লা সম্পদ মাটির নিচে ফেলে রাখা হয়েছে? সঠিক পেশাদার, বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সমাজ কয়লা তোলার দাবি করছে জোরালোভাবে। প্রযুক্তির যুগে প্রমাণিত প্রযুক্তি রয়েছে কয়লা উত্তোলনের সব ঝুঁকি মোকাবিলার। কিন্তু কয়েকজন স্বল্পবিজ্ঞ আমলার পরামর্শে কয়লা তুলছে না সরকার। নানা পর্যালোচনায় স্থলভাগেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সাগরে বিশেষ করে গভীর সাগরে গ্যাস-তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা সর্বজনবিদিত। নির্বিকার সবাই। অথচ বিশাল চ্যালেঞ্জ জেনেও কিছু চিহ্নিত মহলকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে ঝুঁকেছে সরকার। সেখানেও নানা বৈষয়িক কারণে বিশ্বজ্বালানি বাজার উত্তপ্ত থাকায় জ্বালানি কেনার অর্থ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বৈষয়িক সংঘাতের কারণে সাপ্লাই চেন ভেঙে পড়ার উপক্রম। বর্তমান শীত মৌসুমে চাহিদা কম থাকা সত্ত্বেও তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম এলাকায় বিপুলসংখক গ্রাহক মারাত্মক গ্যাস সংকটে ভুগছে। অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্যর্থ পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার কারণে সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস ব্ল্যাক আউট হলো। বর্তমান অবস্থায় ২০২৪-২০২৫ সালে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ নিজেদের কয়লা, গ্যাস মাটির নিচে রেখে কেন আত্মঘাতী পথে হাঁটছে সরকার? 

সীমিত সামর্থ্যের বাপেক্সকেও সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করা হয়নি 

দেশের স্থলভাগে গ্যাস আহরণ এবং উত্তোলনের একক দায়িত্ব সীমিত সামর্থ্যের বাপেক্সের ওপর অর্পণ কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। তদুপরি বাপেক্সকে কারিগরি বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী না করেই অযাচিতভাবে ১০৮ কূপ খননের অপরিণামদর্শী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাপেক্স প্রস্তুতি নিলেও রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। সংগত কারণে ব্যর্থ হয় বাপেক্সের গ্যাসকূপ খনন প্রকল্প। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে দূরভিসন্ধিমূলকভাবে নাইকো রিসোর্স নামের একটি প্রান্তিক কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য বাপেক্সকে অনুসন্ধান এবং উৎপাদন কোম্পানিতে রূপান্তর করা হলেও অনুসন্ধান কোম্পানির মতো যথেষ্ট কারিগরি সক্ষমতা এবং আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনের সহায়তা দেওয়া হয়নি। বাপেক্সের অনুসন্ধান কাজের জন্য একান্তভাবে সৃষ্ট গ্যাস উন্নয়ন তহবিল বাপেক্সকে অনুদান হিসেবে না দিয়ে ঋণ প্রদান করা হয়েছে। জিডিএফ তহবিল অন্যান্য খাতে অপব্যবহার করা হয়েছে। গ্যাজপ্রম নিয়োজিত উজবেক ঠিকাদারকে বাপেক্সের নির্ধারিত খনন প্রকল্পে নিয়োজিত করা হয়েছে। সীমিত সক্ষমতা দিয়ে যথেষ্ট করেছে বাপেক্স। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো ছিল নগণ্য। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সঙ্গত কারণেই স্বচ্ছতার সঙ্গে স্থলভাগেও আইওসিদের পিএসসির আওতায় নিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছে নিয়মিত। উপেক্ষা করে সংকট ঘনীভূত করেছে আমলা নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি ব্যবস্থাপনা। ২০২৪ সালে প্রমাণিত গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হতে চলেছে। একসময় মূলত শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা এবং জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র দুটি থেকে উঁচু হরে গ্যাস উৎপাদন করে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট হরে গ্যাস উত্তোলন করা হলেও উৎপাদন এখন ২১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং কমছে। বাপেক্সের পক্ষে বিপুল ঘাটতি সামাল দেওয়া অসম্ভব। চলতি খনন প্রকল্পগুলো শেষ হলেও উৎপাদন বর্তমান মাত্রায় ধরে রাখা সম্ভব হবে না। 

গ্যাস ঘাটতির বিবেচনায় ২০১০ ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা ধরনের বাধা পেরিয়ে ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় এলএনজি আমদানি এবং ব্যবহার। ১৪ বছর শেষে কক্সবাজার মহেশখালী উপকূলে থাকা দুটি ভাসমান টার্মিনাল ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট আর এলএনজি আমদানির সক্ষমতা আছে। সেখানেও দীর্ঘস্থায়ী এবং স্পট পার্চেজ দুই ধরনের চুক্তি থাকায় বিশ্ববাজারের উচ্চ মূল্যের চাপে পড়ে বাংলাদেশ। একসময় অনেকগুলো এফেসারু এবং ল্যান্ড বেজড টার্মিনাল করার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয় সরকার। একমাত্র মাতারবাড়িতে নির্মিতব্য টার্মিনালটিও দীর্ঘসূত্রতায় ভুগছে। সামিট এনার্জিকে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এক্সসেলেরেট এনার্জি গভীর সাগরে স্থাপনা তৈরি করে সাগর বক্ষে ৭০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করে এলএনজি সরবরাহ করার কথা। ভারত থেকে পাইপলাইনে আর এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চটকদার এই প্রকল্পগুলোর কোনটি বাস্তবায়নের এল দেখবে সেগুলো নিশ্চিত নয়। দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস সংকটের মুখে বাংলাদেশ। 

এদিকে গ্যাস সরবরাহ বিষয়ে নিশ্চয়তা না থাকলেও গ্যাস সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়েছে জিটিসিএল। কম্প্রেসসর স্টেশনগুলো, বেশ কয়েকটি পাইপলাইন অব্যাবহৃত পড়ে রয়েছে। জিটিসিএল সঞ্চালন নেটওয়ার্কের ৬ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস সঞ্চালন ক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে ৩ হাজার এমএমসিএফডির বেশি গ্যাস নেই। একদশক আগে সঞ্চালন ব্যবস্থা খুলনা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলেও গ্যাস পায়নি কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা। কবে পাবে নিশ্চয়তা নেই। তবুও আবার বিপুল বিনিয়োগে বগুড়া থেকে দিনাজপুর হয়ে রংপুর পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে। অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন এখন সবে নির্মাণ শুরু হয়েছে। ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রগুলো জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হয়নি। 

গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বিশেষ করে তিতাস বিতরণ এলাকায় অবৈধ গ্যাস ব্যবহার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিতরণ নেটওয়ার্ক দুর্ঘটনাপ্রবণ। অনেক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রিপেইড মিটার স্থাপন অথবা বিতরণ নেটওয়ার্ক পুনঃস্থাপন করার মতো ব্যয়বহুল কার্যক্রম গ্রহণ না করে গৃহস্থালি গ্যাস ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এলপিজি সহজ প্রাপ্তি, ব্যবহারে নিরাপত্তা এবং মূল্যছাড় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। 

মোট কথা জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কয়লা উত্তোলন, গ্যাস উত্তোলনে যুদ্ধ, জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা, চুরি অপচয় নির্মূল করা ছাড়া মুক্তি নেই। জ্বালানি নিরাপত্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দরকার সঠিক পেশাদারদের সঠিক স্থানে পদায়ন করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। জ্বালানি সংকট মোকাবিলাই এখন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

শেয়ার করুন