২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১০:০৩:২০ পূর্বাহ্ন


বিএনপির সুনশান নিরবতা ও মন্ত্রীর উৎকণ্ঠা নিয়ে নানা প্রশ্ন
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০২-২০২৪
বিএনপির সুনশান নিরবতা ও মন্ত্রীর উৎকণ্ঠা নিয়ে নানা প্রশ্ন


আন্দোলনের মাঠে বিএনপি’র সুনশান নিরবতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিএনপি’র মতো একটি বড়ো দল কি আসলে গ্রেফতার, মামলায় থমকে গেছে? না-কি কারো কেনো বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে বিএনপিকে আবদ্ধ রেখেছে? না-কি কোনো এক জায়গায় বিএনপির রাজনীতি থমকে গেছে? রাজনৈতিক মহল এ-নিয়ে রহস্যের মধ্যে। অন্যদিকে রাজনৈতিক মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র অস্বাভাবিক নিরবতার মধ্যেও সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়েও নানান ধরনের প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। 

২৮ অক্টোবরের পর কি হলো বিএনপি’র?

গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপি’র সমাবেশ ছিল পল্টন ময়দানে। এদিন বিরোধী দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ ছিল উত্তপ্ত। দুটি দলই রাজধানী ঢাকায় খুব কাছাকাছি দূরত্বে সমাবেশ করার ঘোষণাও দিয়েছিল। আর সরকার ছিল হার্ড লাইনে, কেউ কেউ মনে করেন কৌশলে সুযোগ সন্ধানে। কেননা বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ওই সমাবেশ থেকে সরকার পতনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তবে সরকার বাধা না দিলে তাদের আন্দোলন অহিংসই থাকবে, দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এমন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব ভেস্তে গেলো। এই ২৮ অক্টোবরে সহিংস ঘটনার পর থেকে বিএনপি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে। দিয়ে টানা অবরোধ বেশ কয়েকদিন। আবার বিরতি দিয়ে কয়েকবার অবরোধ হরতাল কর্মসূচি। কিন্তু এরপর সরকার ঠিকই একটি নির্বাচন করে ফেলে। এবং ক্ষমতায় এখনো আসীন। প্রশ্ন হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ এনে ঢাকাসহ সারা দেশে অচল করে দেয়া দেয়া হবে। কখনো নেতাকর্মীদের মুখে এমন কথাও শোনা গেছে যে বিএনপি এবার ক্ষমতায় আসছেই। অন্যদিকে একথাও ঠিক যে এই বিএনপি’র ডাকে সারা দেশের যেভাবে যখন সমাবেশের ডাক দিয়েছে জনগণ সেখানে উপস্থিত হয়েছে। রাজধানীতেও এটা হয়েছে। কিন্তু এমন বিশাল বিশাল সমাবেশের পর শুধু ২৮ অক্টোবরে ঘটনায় বিএনপি কোনো এমন কাহিল হয়ে গেলো? দলটির কেনো এখন এমন অবস্থা? এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান ধরনের জল্পনা কল্পনা ছড়াচ্ছে। 

কেনো বিএনপি কি এখন নিবর নিথর?

রাজধানীতে একের পর এক বিশাল সমাবেশ করেছে বিএনপি। এসব সমাবেশের মাধ্যমে সবাই ধরে নিয়েছে সরকার এবার বিএনপি’র সাথে পেরে উঠবে না। কারণ একদিকে বিএনপি’র আন্দোলন অন্যদিকে আছে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের চাপ। সবাই ধরেই নিয়েছিল সরকার পশ্চিমাদের কঠোর নজরদারি আর চাপের মুখে এবার নতি স্বীকার করবে অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। এর পাশাপাশি বিএনপি’কে ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোভাইে নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। দেখা গেলো বিএনপি’কে শুধু বাদ না মাঠ ছাড়া করেই নির্বাচন করে ফেলেছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সব কিছু এতো সহজেই হলো কিভাবে? যে বিএনপি এভাবে মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তারা কার ইশারায় রাজনৈতিক মাঠ ছেড়ে কেনো ক্ষেতখামারে আশ্রয় নিয়েছিল। রাজনীতি করতে এসে কেনো ক্ষেত্র খামারে গিয়ে আশ্রয় নিলো? কেনো এমন পলায়নপর ভূমিকা রাখলো। বিএনপি’র তো এমন আশাই ছিল পশ্চিমাদের কারণে সরকার কঠোর হবে না, হতেও পারবে না। একথাও ঠিক যে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা নিয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গন বেশ সরব ছিল। 

অনেক দূরে অবস্থান করে জাতিসংঘ এই ২৮ অক্টোবরে ঘটনা সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ নিয়ে একটি গণমাধ্যমের প্রথম পাতার খবরটি ছিল ‘জাতিসংঘের সন্দেহে ক্ষমতাসীনরাও’। এতে বলা হচ্ছে, শনিবার (২৮ অক্টোবার) ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও সাংবাদিক লাঞ্ছিতের ঘটনায় রাজপথের বিরোধী দল এবং ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততা ইঙ্গিত করেছে জাতিসংঘ। জেনেভা থেকে পাঠানো জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল এ ইঙ্গিত করেন। লিজ থ্রোসেল বলেছেন, ‘অভিযোগ রয়েছে, ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকের বাসভবনে হামলা চালায় এবং অন্তত ৩০ জন সাংবাদিককে মোটরসাইকেলে আরোহণকারী মুখোশধারীরা লাঞ্ছিত করে, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধারণা করা হয়।’ অন্যদিক অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সকল অংশীজনকে সংযম প্রদর্শন, সহিংসতা পরিহার এবং একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত অন্তত সাতটি বিদেশি মিশন। কিন্তু এসবের পরেও বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সরকার গঠন করে ফেলেছে। 

কারা জড়িত?

২৮ অক্টোবরে কিভাবে কারা এমন সব ঘটনার পেছনে, যা আজও রহস্যাবৃত্ত। এখন বলা হচ্ছে রেলওয়রে নাশকতার ব্যাপারে পুলিশ কিছুই জানে না। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেলো ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটিতে পরিকল্পনা করেই আগুন দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে রেল পুলিশ। তবে এই ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা রেল পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। ঘটনার দিন রাত নয়টার দিকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে তিনটি কোচ পুড়ে যায়। মারা যান চারজন। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ঘটনায়ও নাশকতার দাবি করেছিল পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই দিন তেজগাঁও স্টেশনে সব কটি সিসি ক্যামেরা বিকল ছিল।

এখনো কেনো সরকারের মুখ উদ্বেগের কথা

বিএনপি এখন নিরব নিথর। তবে অনেক বলাবলি পর একটি কর্মসূচি নিয়ে নেমেছে দলটি। তা হলো ঢাকাসহ সব সাংগঠনিক মহানগরে ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার থেকে টানা দুদিন লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। একই কর্মসূচি পালন করবে এলডিপি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন সাদামাটা কর্মসূচি নেয়ার পরও কেনো সরকারের প্রভাবশালী ও যিনি বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দেন তিনি এবার কি বললেন? সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পরিস্থিতি কখন কি হয় বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কী হবে সেটি বোঝা যাচ্ছে না। সবকিছু মিলে ২০২৪ সালে কী রেজাল্ট হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না। এপ্রসঙ্গে আরেকটু বিস্তারিত বলতে গিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা করে বা সম্পর্ক নষ্ট করে রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না বাংলাদেশ। ভিন্ন কৌশলে রূপপুরের জন্য বেশ কিছু জিনিস আনা হয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা না হয়। আবার বলেছেন বিএনপিকে পাত্তা দিচ্ছি না এমন না। কার অবস্থা কখন কি হয় বলা যায় না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন তার এই বক্তব্য এসময়ে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। এই ধরনের বক্তবেই বোঝা যায় অনেক কিছু-বোঝা যায় কেনো হুট হাট করে বিএনপি’র নেতারা মুক্তি পাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে যখন সর্বত্র নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে তখন খোদ প্রভাবশালি মন্ত্রী কেনো এমন কথা বলছেন? কেনো বিএনপি দৃশ্যত চুপচাপ। কেনো এখনো লিফলেট কর্মসূচি নিয়েই এগুচ্ছে। কারো কারো মতে, বিএনপি কি একটু দম নিচ্ছে? না-কি একটি টাইম ফ্রেমে আছে? না-কি সুনিশ্চিত কোনো নিশ্চয়তায় দলটি একটু পিছুটান নিয়েছে? কেনো সেতুমন্ত্রী বললেন, ২০২৪ সালে কী রেজাল্ট হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না? কিসের রেজাল্ট? আমেরিকায় জো বাইডেন আর ট্রাম্পের লড়াই দেখার অপেক্ষার কথা বলছেন তিনি? না-কি পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে সব খেলা শেষ। এরপরতো আছে মিয়ানমার সঙ্কট। এসব শেষে বাংলাদেশের খবর নেবে আমেরিকাসহ পশ্চিমারা? এমন পরিস্থিতির কি ইঙ্গিত দিলেন সেতু মন্ত্রী? কেনো কূটনৈতিক অঙ্গন নিয়ে এমন বাকা কথা বললেন তিনি? সেতুমন্ত্রী বলেছেন ”যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা করে বা সম্পর্ক নষ্ট করে রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না বাংলাদেশ। কি বোঝালেন তিনি? এখন কি কোনো ভূ-রাজনৈতিক চাপের মুখে তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন? প্রশ্ন হচ্ছে এর আগে খোদ সরকারের শীর্ষ মহল থেকে কেনো বলা হয় হয়েছিল যে মার্চে দুর্ভিক্ষ? নির্বাচনের আগেই এমন আশঙ্কা করা হয়। আগাম বার্তায় বলা হয় আগামী বছরের মার্চের দিকে দেশে ‘দুর্ভিক্ষ ঘটানোর’ দেশী-বিদেশী পরিকল্পনা রয়েছে। এই বলে মন্তব্য করেছিলেন আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। খোদ প্রধানমন্ত্রী। আবার বলা হয়, ‘নির্বাচনের শিডিউল হয়ে গেছে। এখন তারা (বিএনপিকেই উদ্দেশ্য করে) মনে করছে নির্বাচন হয়েই যাবে। তাই তারা মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটা শুধু দেশের নয়, বাইরের দেশেরও পরিকল্পনা। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে সে সময়ে কারা তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন তাই তিনি বলে ফেললেন যে ‘এখন তারা মনে করছে নির্বাচন হয়েই যাবে।’ তাহলে কি ধরে নেয়া যায় নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাজনীতির মাঠে কোনো পক্ষের মৌন্য সম্মতি ছিল? এই জন্যই কি জোরালোভাবে রাজনৈতিক মাঠে নামা হয়নি কোনো পক্ষের? রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন সব প্রশ্ন সবদিক থেকেই আসছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, সব কিছু দৃশ্যমান হতে কি অল্প সময়ই আছে হাতে- এমনটাই কি সেতুমন্ত্রীর বক্তব্য উঠে এসেছে? আবার সেতুমন্ত্রী যেদিন এমন কথা বললেন ঠিক সেদিনই খবর প্রকাশিত হয় যে পিটার হাসের সঙ্গে মঈন খানের বৈঠক করেছেন। গণমাধ্যমে যা এসেছে তাতে দেখা যায় যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন কী করবে তা না-কি জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে বিএনপি বলেছে, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসহ এক দফা দাবিতে তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলবে। ফলে পুরো বিষয়গুলোই রাজনৈতিক মাঠে নানান গুঞ্জনেরই জন্ম দিচ্ছে। বিএনপি’র সুনশান নিরবতা মন্ত্রীর উৎকন্ঠা নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তরগুলো আসলে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আর বক্তব্যে এমনটাইরই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে কেউ কে মনে করেন।

শেয়ার করুন