২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১১:১৫:০৯ পূর্বাহ্ন


মধ্যবর্তী নির্বাচনের চাপ বাড়াচ্ছে পশ্চিমারা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৩-২০২৪
মধ্যবর্তী নির্বাচনের চাপ বাড়াচ্ছে পশ্চিমারা


বাংলাদেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য পশ্চিমারা চাপ বাড়াচ্ছে। এর পাশাপাশি মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি আদায় করে নিতে বিএনপি মাঠে নামছে। এজন্য আপাতত মামলা-মোকাদ্দমায় বিপর্যস্থ দলটি নিজেদের আবারো সংগঠিত করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আন্দোলনের মাঠে শরিকদের মতামত নিচ্ছে। তাদের ক্ষোভ-দাবি ও পরামর্শ আমলে নিয়ে মাঠ গোছাচ্ছে। এসব কথা জানা গেছে রাজনৈতিক অঙ্গনের মাঠ থেকে। 

পশ্চিমাদের চাপের নমুনা

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারিতে হয়ে গেলো বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের পর পর আমেরিকা যুক্তরাজ্য কঠোর অবস্থান জানালেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রথমে একটু হালকাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল নমনীয়। প্রতিক্রিয়া বলা হয় বড় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসায় দুঃখ বা হতাশা প্রকাশ করে সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে হওয়া অনিয়মগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহবান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু বলা যায় সবচেয়ে কঠোর ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদন্ড অনুযায়ী হয়নি বলে অভিমত দিয়েছে যুক্তরাজ্য। কিন্ত এই নির্বাচন নিয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ বলা যায় কোনো ধরনের উচ্চবাচ্চই করেনি। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলন করে জানান দেন যে, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব আমাদের আছে। ফ্রান্স জলবায়ু পরিবর্তনের (প্রভাব মোকাবিলার) জন্য ১ বিলিয়ন ডলার দেবে। ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক আছে, আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায়ও সুবিধা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি (জার্মানি সফরে)। তারা নিজেরাই জানত নির্বাচনে আমি জিতে আসব।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর বলা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ধরে নেয়া হয় সফল কূটনীতিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কারণে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। 

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সে-ই ইউরোপীয় ইউনিয়ন মাত্র কয়েকদিন আগে ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মানদন্ড পূরণ করতে পারেনি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার যার মধ্যে সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত- এগুলো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা সীমাবদ্ধ ছিল। বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়েছে। বলা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী ও দলের সাথে যুক্ত ’স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা ভোটারদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। মিডিয়া এবং সুশীল সমাজও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল না, সমালোচনামূলক পাবলিক বিতর্কও সীমিত ছিল। 

শক্ত অবস্থানের জানান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

এদিকে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এর পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক মানদন্ড অনুয়ায়ী যেনো হয় সেটি নিশ্চিতে আমেরিকার চাপ অব্যাহত রাখবে এমন আভাস কূটনৈতিক মহলেও আছে। একজন কূটটনীতিক এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হউক এটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস্টিজ ইস্যু। তাই বিষয়টির এতো সহজে সুরাহা হচ্ছে না। তার মতে, র‌্যাবের ওপর নিষেধজ্ঞা প্রত্যাহারে এবারে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সাথে সাথে সায় দেয়া হয়নি। বরং র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এবং সেগুলি অনুসরণ করা হলেই গ্রিণ সিগনাল দেয়া হবে। এদিকে র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে একটি জটিল প্রক্রিয়া পার করার পথে হাটতে না হাটতে তৈরি পোশাক রপ্তানি নিয়ে মার্কিন শুনানিতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। গণমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে এমন পাঁচ দেশের বিষয়ে শুনানি গত ১১ মার্চ সোমবার ভার্চ্যুয়ালি আয়োজন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি)। প্রায় চার ঘণ্টার ওই শুনানির বড় অংশ জুড়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়েন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। ইউএসআইটিসির চেয়ারম্যান ডেভিড জোহানসন ও তাঁর তিন সহকর্মী বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, শ্রম আইন, শ্রমিকদের উৎপাদনের তুলনামূলক দক্ষতা, মজুরিসহ নানা বিষয়ে জানতে চান। গত বছর থেকে বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি, ট্রেড ইউনিয়নসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে সুরাহার তাগাদা দিচ্ছে। অন্যদিকে জো বাইডেন প্রশাসন নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে। এদিকে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার কার্যক্রমে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে একজন সাংবাদিককে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর জন্য বাংলাদেশের আইনের সম্ভাব্য বড় রকমের অপব্যবহার হতে পারে। বাংলাদেশে মার্কিন সরকারের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্রদূত হাস কেবল সেই মন্তব্যগুলো পুনরুক্ত করেছেন। কূটনৈতিক মহল মতে করে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের এধরনের বক্তব্যও সামনের দিনে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিমাদের কঠোর চাপের আভাস দেয়। 

শেষ কথা

প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমারা যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন নিশ্চিতে বাংলাদেশে চাপ দিয়ে যাচ্ছে তা সরকারের পক্ষ থেকে বলা যায় কিছুটা লুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সব মাটি করে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি হুট করে বলে ফেলেন একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে। বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন মামা বাড়ির আবদার? প্রশ্ন হচ্ছে তিনি একথা বললেন কেনো? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার পর আরো একটি নির্বাচন দেয়া হবে এমন কি কোনো গোপন সমঝোতা হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মোড়লদের মোড়লীপনায়? তা না হলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরই দেখা গেলো বেশ কয়েকটি নাটকীয় দৃশ্য। ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৪৮ মিনিটের দিকে কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা ভেঙে নেতাকর্মীদের প্রবেশ। আবার দেখা গেলো ৫ মাস পর বাসায় ফিরলেন বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এসময় রাজনৈতিক মহলে বেশ কৌতুহল আর রহস্যের জন্ম দিয়েছে এমন ঘটনা। আবার দেখা গেলো এপর্যন্ত বিএনপি’র তেমন জোড়ালো কর্মসূচি নেই। অথচ একের পর এক বিএনপি নেতাও মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন, জামিনও মিলছে। সবই রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। মনে করা হচ্ছে বিএনপি’কে আশ্বস্ত করা হয়েছিল কি-না নির্বাচনের পরপরই নতুনভাবে কিছু করা হবে। তা না হলেই কেনোই বা নির্বাচনের পরপরই বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের খেলা শেষ, পাঁচ বছরের জন্য এখন খেলা হবে রাজনীতির? ধারণা করা হচ্ছে পশ্চিমাদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সে-ই মধ্যবর্তী নির্বাচনের চাপ দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। আর সে-কারণেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরব নিথর অবস্থায় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে ফেলেন মধ্যবর্তী নির্বাচন কোন দুঃখে? মামা বাড়ি আবদার? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, পশ্চিমাদের চাপের পাশাপাশি দেশের ভেতরে অবস্থা-সব মিলিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি আচ করতে পেরে আ.লীগ মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইস্যুটি বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি’র মাঠ গোছাচ্ছে কিভাবে মধ্যবতী নির্বাচনের দাবিটি আদায় করে নিতে পারে। এখন দেখা যাবে আগামী কয়েকটি মাসে এমন দাবি নিয়ে দেশে বিদেশে কেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। 

শেয়ার করুন