বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি যে সরাসরি সেনাবাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকার পরেও বিগত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর পর সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কাউকেও হাল ধরার জন্য পাওয়া যায়নি। বস্তুত ৫৫ বছর ধরে বাংলাদেশের সম্মুখপানে পথ চলার বাঁকে বাঁকে নদীর ঘূর্ণি পেরোতে সেনাবাহিনীকে দাঁড় টানতে হয়েছে। প্রতিবারই সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। কিন্তু এবারই যে, প্রথমবার সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক শক্তিই বার বার টেনে নিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতযাত্রার মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের আপাতত অবসান হিসেবে ধরা হলেও বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেন ক্ষমতা থেকে পতন হলে কোথায় যাবেন তার হিসাব-নিকাশ করছে। আওয়ামী লীগের দলীয় কুকীর্তিকারকরা আজ ভারতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিএনপির অবস্থান এমন হলে কি তারা ভারতে যেতে পারবে? আর তা যদি না হয় তারা কোথায় যাবেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার যখন পাঁয়তারা করে তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে স্বদেশে ফেরার পথেই বলেছেন, ‘যদি ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল করতে চায় তাহলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।’ তারপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তার পর পর বিএনপি নেতারা নির্বাচন দাবি করে। তারা মনে করে নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় চলে যাবে। কিন্তু সে সময় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সুযোগ ছিল না। সুযোগটা তৈরি করতেও বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোন সুযোগ দেয়নি। শুধু তাই নয় বিএনপি যদিও জাতীয় সরকারের ধুয়া তুলেছিল সে সময় কিন্তু জাতীয় সরকার নিয়ে কোন কথা বলেনি। তারা আচরণ করতে থাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরোধী সরকার হিসেবে। কিন্তু কেন? তার উত্তর হচ্ছে বিএনপির চলমান নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কোন শক্তি ছিল না। বিএনপির মধ্য থেকে বিভিন্ন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া হয় কিন্তু তার পরিবর্তে বিএনপি কোটাবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক উৎকর্ষতার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। যেমন শেখ হাসিনার পতনের কয়েকদিন পূর্বেও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, তারা এখন সরকার পতনের কথা ভাবছেন না। কাজেই বিএনপির নেতৃত্বকে বলা যায় জনগণের কাতার থেকে তারা শটকে পড়েছিল। এরপর ৫ আগস্ট আসল, শেখ হাসিনা চলে গেলেন দিল্লি তার কাঙ্ক্ষিত শেল্টারে। আর বিএনপির আচরণ হলো বিরোধী দলের মতো।
এদিকে আন্দোলনের যে বিদেশি শক্তি মহরত ও সানাই বাজিয়েছিল সেই আমেরিকার ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট’ যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে মাথা ঘামাচ্ছিল তারাও কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। কারণ মাত্র তিন সপ্তাহের অবিরাম জীবনদানের আন্দোলনের পরিণতি যেভাবে সমাপ্তি হয় তার জন্য অন্যান্যরা তৈরি থাকলেও বিএনপি তৈরি ছিল না। কারণ আন্দোলনের অন্তর্নিহিত শক্তির সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। ৫ আগস্টের পর বিএনপির বাংলাদেশে মাঠের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে সালাউহদ্দীনের। যিনি ভারত থেকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তির পর বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। আর এসেই ভারতপ্রীতির বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে এবং ভারতের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে কিংবা শেখ হাসিনা বিচারের সম্মুখীন করতে তাকে যাতে ভারত ফেরত দেয় তার দাবি জানাতে বিএনপির নেতারা কোনোভাবেই মুখ খুলছেন না।
২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এক জরিপ চালিয়েছিল সেখানে দেখা গেছে ৭৭ শতাংশ লোক বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এখন আবার নতুন করে শোর উঠেছে নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কে করবে এ সরকার। কীভাবে হবে এ সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কি ড. ইউনূস থাকবেন না অন্য কেউ আসবেন। এই প্রশ্নের কারণ হচ্ছে বিএনপি যতটুকু চুপ্পু মিয়ার ওপর নির্ভর করে, ততটুকু ড. ইউনূসের ওপর নির্ভর করে না। তার হয়তো কারণও আছে। কারণ ড. ইউনূস এখন সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। তবে তার নেট অবদান হচ্ছে কীভাবে বাংলাদেশ ভারতের চোখ রাঙানিকে থামিয়ে নিজের সার্বভৌমত্ব নিয়ে, অলটারনেটিব বা (বিকল্প) সিকিউরিটি সিস্টেম তৈরি করে পথ চলতে পারে তার শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছে। তবে মনে হয় যেন, বিএনপির সে শিক্ষার প্রয়োজন নেই। তারা ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায়। তবে তাতে যে, চীনের কিল লাথি খাওয়া কিংবা আমেরিকার ফিজজেরালও নৌ-জাহাজের দাবড়ানি খাওয়ার ভয় আছে, তাতে তারা বিস্মিত হয়।
সম্প্রতি এক সংবাদ চাউর হয়েছে, ফখরুল ইসলাম সাহেব কচুবন দিয়ে সেনানিবাসে জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, সব সময় দেখা গেছে সামারিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়া বা দেওয়ার জন্য বেসামরিক রাজনৈতিক শিবিরে আসে কিন্তু এবার দেখলাম কচু বন দিয়ে তারা ওয়াকারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। তারা নাকি ওয়াকারকে বুঝিয়েছেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। ইউনূসকে চায় না। এ দাবি তারা তুললে ওয়াকার যেন তাদের সমর্থন করে। এর চাইতে বড় সুযোগ ওয়াকার, কিংবা ভারত পাবে কোথায়?
এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এখন শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেছে। বলছে যদি তারা কোন ভুল করে তাহলে তারা ক্ষমা চায়। প্রশ্ন হলো ১৯৭১ সালে তারা ভুল করেছে কি না? ১৯৭১ সালে তারা পাকিস্তানিদের দালালি করেছে কি না। সে জন্যই তাদের নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় এ ক্ষমা চাওয়ার দাম নেই। বহুদিন পরে অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক একটি কথা বলেছে, তিনি বলেছেন ঐকমত্য কমিশন না করে বিষয়টি অন্যভাবে হতে পারতো। আসলে তার মতো প্রজ্ঞাবানকে বোঝা ভাড়াটিয়া গরু মার্কা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ আজ ক্রান্তিকালের মধ্যদিয়ে চলছে। এই দেশকে টেনে তুলতে বিকল্প ভাবতে হবে।