২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৬:২০:০৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


কোন পথে এগুচ্ছে জাতীয় পার্টি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০২-২০২৩
কোন পথে এগুচ্ছে জাতীয় পার্টি


জাতীয় পার্টির কোন নীতিতে চলবে এমন একটা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। দলটি কী সরকার বিরোধী অবস্থানে থাকবে, নাকি বরাবরের মতই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহায়ক হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলছে। সরকার দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অনেকেই অভিযোগের সুরে বলছেন, ‘ইদানিং অতি ডান, অতি বাম সব এক হয়ে গেছে।’ এ কথার অনেক অর্থ রয়েছে। ফলে এমন প্রেক্ষাপটে দেশের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির দল জাতীয় পার্টির অবস্থানটা জানার আগ্রহ স্বাভাবিক। তবে দলটির উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে সম্প্রতিককালে। চেয়ারম্যান ও সংসদ উপনেতা জিএম কাদেরের উপর নিষেধাজ্ঞার খড়ক নেমে এসেছিল আদালত থেকে। যাতে ছিল রাজ্যের বিস্ময়। দলের নেতাদের করা মামলায় চেয়ারম্যানের কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা কম আলোচিত হয়নি। তবে অনেক কষ্টে ওই অবস্থান থেকে উঠে আসতে পেরেছে জাতীয় পার্টি। 

জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘঠনা তুলে ধরা হলো নিম্নে। যা থেকে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা কিছুটা হলেও সম্ভব- 

হঠাৎ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান 

সংসদে আপষে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ বেশ কিছুদিন থেকেই সরকারের প্রচন্ড সমালোচনা শুরু করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ভাষাতেই সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন তারা। এর ষুত্র ধরেই বাংলাদেশের জাতীয় একটি পত্রিকায় সরকারের কড়া সমালোচনা করে সাক্ষাতকার দেন। যার কিছু অংশ তুলে দেয়া হলো নিম্মে- 

৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ : সরকারের কঠোর সমালোচনা করে সাক্ষাতকার 

এদিন প্রকাশিত ওই সাক্ষাতকারে  জিএম কাদের বলেন, ‘সরকার জানে তারা দেশ পরিচালনায় পুরোপুরি ব্যর্থ। দেশের মানুষ আর তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায় না। অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু ভোট হলে তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এজন্য তারা অতীতের মতোই নিজেদের মনমতো সাজানো ছকের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে চায়। মানুষ ভোট দিতে পারুক কী না পারুক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নির্বাচন কমিশনও সরকারের হয়ে সেই ছকে বাঁধা সাজানো নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটছে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। কিন্তু সরকারি দল চায় ইভিএমে নির্বাচন। তাই নির্বাচন কমিশনও ইভিএমে ভোট করতে চায়। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল চায় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। কিন্তু এর ঠিক উলটোপথে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন। এটা হলে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের দুর্যোগ আসবে।’ 

সরকার এবং সরকারি দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণেই কি আপনি এখন এত বেশি সমালোচনায় সোচ্চার-এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয়। আমি বা আমরা সরকারের সমালোচনা করি, করছি। তাদের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরছি। লুটপাট-অনিয়ম-দুর্নীতি-অর্থ পাচারের কথা বলছি। যা বলছি তা তো মিথ্যা বলছি না। এই সরকার মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে। আইনের শাসন নেই। কথা বলার অধিকার নেই। মানুষের কথা সরকার শোনে না। মানুষের মনের ভাষা সরকার বোঝারও চেষ্টা করছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ডলার সংকট। রিজার্ভ সংকট। অর্থনীতির সংকট। শিল্পায়ন নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। ঋণখেলাপির সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ব্যাংক খালি হয়ে যাচ্ছে, টাকা নেই। খাদ্য সংকট। জ্বালানি সংকট। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে দেশের বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো, রিজার্ভ পর্যাপ্ত-সরকার মুখে এসব কথা যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে দেশ শ্রীলংকার পথে হাঁটছে। রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে আমরা বড় ধরনের দুর্যোগ দেখছি।’

জিএম কাদের বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, ইভিএম হচ্ছে কারচুপির মেশিন। আবার নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বলছে, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব নয়। তাই নির্বাচন কমিশন সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে-তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ আছে। মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে মাতামাতি করছে। অন্যদিকে দেশের মানুষ কথা বলতে পারছে না। কোনো দাবিতে আন্দোলন হলে পুলিশ ও প্রতিপক্ষরা হামলা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় নির্বাচন হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হবে না। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের ৯০ ভাগ জায়গায় সরকারের একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন সরকারের হাতে, এমন বাস্তবতায় অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, সরকার একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এই প্রকল্পের নামে লুটপাট করছে। কাজের শুরুতে একদফা লুটপাট। কাজের মাঝখানে আরেক দফা লুটপাট। কাজের শেষেও লুটপাট। সর্বত্র লুটপাটতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। সরকার এবং সরকারি দলের ছত্রছায়ায় কিছু লোক লুটেপুটে খাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক হচ্ছে।’ 

আপনারা কি এখন আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে নেই-জবাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা অনেক পুরোনো কথা। আমরা বহুদিন ধরেই বলছি-জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, এখন নেই। মহাজোট বলেও এখন আর কিছু নেই। আমরা আমাদের মতো করে পথ চলছি। আমরা দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে সংগঠিত এবং শক্তিশালী করাটাকেই এই মুহূর্তে প্রাধান্য দিচ্ছি।’ 

৪ অক্টোবর ২০২২ : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা 

জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত জিয়াউল হক মৃধা জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের যাবতীয় দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী আদেশ দেন। 

একই আদালতে জাতীয় পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা জি এম কাদেরসহ চার জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। এতে বলা হয়, জি এম কাদের গত ১৭ সেপ্টেম্বর অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধাকেও জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বরের কাউন্সিলসহ চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ অবৈধ ঘোষণা করতে এবং হাইকোর্ট বিভাগের রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পার্টির পরবর্তী কাউন্সিল স্থগিত রাখতে মামলায় আদেশ চাওয়া হয়।

৬ অক্টোবর ২০২২ জাতীয় পার্টির পক্ষে শেখ সিরাজুল ইসলাম, কলিম উল্যাহ মজুমদারসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী এই আবেদন করেন। আবেদনে জি এম কাদেরের ওপর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রত্যাহার চাওয়া হয়। 

৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : হাইকোর্টের রায় জিএম কাদেরের পক্ষে  

তারিখে আদালত জানায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের। নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করে ওই রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রোববার বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সেই সঙ্গে নিম্ন আদালতের রায় কেন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন হাইকোর্ট।

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে বলে বক্তব্য 

এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার চাইলে আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেব। 

সোমবার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন জিএম কাদের। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আদালতের ওপর শ্রদ্ধাশীল। আমরা আদালতের সব নির্দেশনা মেনেই চলেছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধানের কয়েকটি ধারার কারণেই বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতায় ঘাটতি আছে। ওই ধারার কারণে বিচার বিভাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় শুধু জাতীয় পার্টি নেতাকর্মীই নয়, দেশের সাধারণ মানুষও খুশি হয়েছে। 

তিনি বলেন, দেশ থেকে দুর্নীতি, দুঃশাসন, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য দূর করতেই আমরা রাজনীতি করছি। দেশের মানুষ মনে করছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ে জাতীয় পার্টি দেশ পরিচালনায় অনেক বেশি সফলতা অর্জন করেছে। তাই দেশের মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিকল্প শক্তি হিসাবে দেখতে চায়। 

সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : জোটবদ্ধ হওয়া অর্থ ক্রীতদাস নয় 

মঙ্গলবার বনানীস্থ জাতীয় পার্টির অফিসে কুমিল্লার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতকালে নির্বাচনে জোটবদ্ধ (আওয়ামী লীগ বা অণ্য কোনো বড় দলের সঙ্গে) হওয়া বন্ধুত্ব, ক্রীতদাস হওয়া নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। তিনি বলেন, নির্বাচনে আমরা জোটবদ্ধ হওয়াকে বন্ধুত্ব মনে করি। জোটবদ্ধ হওয়া মানে ক্রীতদাস হওয়া নয়, জোটবদ্ধ মানে দাসত্ব নয়। আমরা রাজনীতি করি। দেশের মানুষের স্বার্থই আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা-

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম চালাতে তার উপর নিষেধাজ্ঞার আগে তিনি যেভাবে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য রেখেছেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর তিনি কিছুটা সফট সুরেই কথা বলছেন বলে উপরোক্ত বক্তব্যে উঠে এসে। তবে তার আগ ও পরে একটা বক্তব্য স্পষ্ট, জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে। এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজনে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে পরামর্শ প্রদান করেন।

শেয়ার করুন