২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৬:৫৯:৫৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


মোদির ভারত হিন্দুত্বের নিগড়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৮-২০২২
মোদির ভারত হিন্দুত্বের নিগড়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে নরেন্দ্র মোদি


ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অবিমৃষ্যকারী বেদমের ভূমিকার সাথে গো-সেবক, মুসলিম-বিদ্বেষী ও শ্লাঘায় ভরা মোদি সরকারের যোগসাজশে যে এক ভয়ঙ্কর স্বৈরসরকার গড়ে উঠেছে, আসলে তা ভারতকে এক গণতন্ত্র বিনাশক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চলেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের শিরোনামে একটা স্লোগান ছাপা হয়, যার অর্থ ‘গণতন্ত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে মরে যায়’। ভারতের যেসব মহামানব, মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, বল্লভ ভাই পাটেল, জয় প্রকাশ নারায়ণ কিংবা আমভেদকর, নেতাজী সুভাষ বোস, শরৎ বোস, মওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, বি আম্মা, বেগম হজরত মহল, আবাদী বানু বেগম, বিবি আমাতুস সালাম, হাজারা বেগম, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, রানী লক্ষ্মী বাঈ, সরোজিনী নাইডু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাস্টারদা সূর্যসেন, হাবিব ও ক্ষুদিরামসহ আরো অনেকের আত্মাহুতি তিলে তিলে যে, ভারতকে গণতান্ত্রিক ভারত হিসেবে গড়ে তুলেছে, তা মোদির সর্বভুক সহিংস মনোভাব ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

গত ৮ বছরে তার ক্ষমতারোহণে থেকে তিনি ভারতীয় গণতন্ত্রকে অপবিত্র করে তুলেছে। দেশের অসহিষ্ণু হিন্দু প্রাধান্যবাদীদের ব্রুট মেজরিটি দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা, ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহ্য করা রীতি, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও নাগরিকদের সমঅধিকারের নীতিকে ধ্বংস করেছে। ২০০২ সালের গুজরাটের ঘটনার জন্য মোদি ছিল দায়ী। তার কোনো বিচার পরবর্তী কংগ্রেস সরকার বা সে সরকারের বিচার বিভাগ করেনি। আর তা না করে ভারতে মুসলিম নিধনকে প্রকারান্তরে জায়েজ করা হয়েছে। তা অবশ্য বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ে মিলে করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কংগ্রেসের আমলেই নড়বড়ে হয়েছে। যেমন- ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী যুবকদের সারা দেশে বিনাবিচারে হত্যা করেছে মাও বিরোধিতার নামে ও নকশাল বিরোধিতার নামে। দখল করেছে স্বাধীন সিকিমকে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দৃঢ় না করে পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে। খালিস্তান নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিচার না করে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে শিবসেনা, আরএসএস, ভারতীয় জনতা পার্টি, যারা সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে ভারতে হিন্দু প্রাধান্যবাদীদের রক্তপিপাসু নীতির মহড়া দিয়েছে তাদের উসকে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন কিছুটা সংস্কার হলেও সেশনের নেতৃত্বে, আইনের শাসন সংঘ পরিবারের দিকেই ঝুঁকেছে। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছিল, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিকদের সমঅধিকার নীতির ভিত্তিতে। 

কিন্তু ক্রমাগতভাবে গত ৮ বছর ধরে এই মোদি সরকার নিজেদের নাজি জার্মানিদের সাথে তুলনা করতে শুরু করে দেয়। তার সরকারি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে সংহারি লোকদের। সমালোচকদের চুপ করার শাসন চালাতে থাকে আর মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চালায় অমানবিক অত্যাচার। সামাজিক বৈষম্যকে জাগিয়ে দিয়ে তারা সহিংসাকে দৃশ্যমান করে তোলে। নাগরিক স্বাধীনতাকে সমাগতভাবে লঙ্ঘন করা হয়। ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ডেমোক্রেসি, যেখানে উদারনীতি ও অত্যাচারী সংহারি দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সারাবিশ্বে চলছে যুদ্ধ, সেখানে উদারনীতির পক্ষে ভারত অপসৃয়মান। তারপরও দেখ যায়, আমেরিকার মতো দেশ মোদিকে পরিত্যাজ্য না করে ভারতের বাজারে প্রবেশের জন্য তাকে তোষামোদি করছে। আমেরিকার আরেক উদ্দেশ্য চীনের বিরুদ্ধে স্ট্যাটেজিক কাজে ভারতকে ব্যবহার করা। 

গত বছর সুইডেনের ভি ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট ভারতকে ‘নির্বাচনী স্বৈরাচার’ বলে অভিহিত করেছে। আর ওয়াশিংটনের ফ্রিডম হাউস ভারতের অবস্থানকে ‘আংশিক মুক্ত’ বলে বর্ণনা করেছে। আর ভারতের এই অধঃপতন বিশ্বের ১.৩ বিলিয়ন লোককে গণতন্ত্রের উদারনৈতিকতা বঞ্চিত করেছে। আর তাতে বিশ্বের ব্যালান্স অত্যাচারীর দিকে হেলে পড়েছে। বিশ্বের ২০ শতাংশের চেয়েও কম লোক এখন মুক্তবিশ্বের বাসিন্দা। যদিও ভারতের সর্বগ্রাসী টাইরেনির দিকে ঝুঁকেপড়া মোদির অধীনে ঘটেছে। কিন্তু সব দোষ তার ওপর দিলে ঠিক হবে না। আগেই বলেছি, দুর্বল সরকারি ভিত ও সামাজিক অসমতা শুরুতে ভারতকে গ্রাস করেছে। আর তাতে গণতন্ত্রের শক্তি দুর্বল হয়েছে। আর তা হিন্দু প্রাধান্যবাদীদের উত্থানে সহায়ক হয়েছে। ব্যাপক দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা ও চরম গোত্রগত, ধর্মীয় ও সামাজিক বৈচিত্র্যতা সত্ত্বেও ভারত তার শুরু থেকে এক অসম্ভব গণতন্ত্রের চর্চা করেছে। এই দেশ এক প্রগতিশীল সংবিধান গ্রহণ করেছে, কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী প্রশাসনিক কাঠামো রেখে দিয়েছে। আর তা নির্বাচিত স্টেট ও জাতীয় নির্বাহী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠানের ওপর অবাধ ক্ষমতা দিয়েছে। যেমন- পুলিশ ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, যাদের চরিত্র কালো নাগিনের চাইতেও ভয়ঙ্কর। তারা খুন করতে, অত্যাচার করতে, ধর্ষণ করে হত্যা করতে কসুর করে না। সহিংস নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রদ্রোহ দমনের আইন নির্বাচিত স্টেটও জাতীয় নেতৃত্বকে সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে প্রোটেকশন সমেত অধিকার দিয়েছে। মোদির দল এই অত্যাচারের হাতিয়ার সমূহকে সহিংসতার সাথে প্রয়োগ করেছে। আর প্রথমবারের মতো তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। 

পশ্চিমবাংলায় দেখা গেছে, কংগ্রেস পার্টি একসময় গুন্ডা ও পুলিশ ব্যবহার করে বিরোধীদের দমাতো, তারপর আসে কমিউনিস্ট পার্টি। ৩৪ বছর তারা ক্ষমতায় ছিল আর তারা স্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো মাস্তান দিয়ে চালিয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকার মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায়। এই দল জাতীয়ভাবে নিজেদের মোদির কর্তৃত্ববাদের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করায়। কিন্তু তারা কমিউনিস্টদের মতো ব্রুট ফোর্সের ওপর নির্ভরশীল। তাদের রয়েছে অর্থলিপ্সু সহযোগী ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত। স্টেট লেবেলে এই ভয়ঙ্কর প্রভাব বেশ দৃশ্যমান। মি মোদি ১৩ বছর যাবৎ লৌহ মুষ্ঠিতে গুজরাট শাসন করেছে, ২০০২ সালে যিনি মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা উসকে দেয়। ভারত হচ্ছে, এমন গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে রাজনৈতিক দলসমূহ গণতান্ত্রিক নয়। নিজেদের দলের অভ্যন্তরে কোনো নির্বাচন হয় না। 

ভারতের রাজনীতিতে অর্থ ও অপরাধ জগতের যোগাসাজশের প্রতিপত্তি ব্যাপক। আইনপ্রণেতাদের কেনা ও বেচা যায়। আইন প্রণয়নে কেউ কোনো কিছু চর্চা করে না। বরং ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার নীতিকে রাবার স্ট্যাম্পিং করে। প্রায় সময় তারা বিশেষ স্বার্থবাদী মহলের হাতে বন্দি। তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। যেমন- কৃষি আইন, যার বিরুদ্ধে কৃষকরা ক্রমাগত আন্দোলন করে গত বছর বাতিল করিয়েছে। কিন্তু ভারতে সুস্থ, প্রতিবাদী গণতন্ত্রের বিকাশ এক ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। আর তাতে দরিদ্রতম নাগরিকদের রক্ষা করা বা তাদের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়।

ভারতে ক্ষুধা থেকে লাখ লাখ শিশু প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে। এ কথা আমার নয়। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। এক-তৃতীয়াংশ লোক ক্ষুধায় থাকে, যদিও আম্বেনীর পরিবার আরব আমিরাতে ৮০ মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কেনে। বিশ্ব ধনকুবেরের পাশে নাম লেখায়। নতুন উদারনৈতিক ভারতীয় নীতি অসমতা বাড়িয়েছে। কারণ স্টেট স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সহায়তা দান থেকে বিরত থাকছে। আর তা এক অমর্যাদাকর জীবনের সৃষ্টি করছে এবং কোটি কোটি লোককে ক্ষমতাহীন করে তুলেছে। তারা বিভিন্ন শ্রেণির নাম নিয়েছে। তাদের নিয়ে বিভিন্ন নেতারা প্রতিশ্রুতি দেয় তাদের রক্ষা করার, গ্রুপবাজিতে ব্যবহার করে। ধর্মীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপে ব্যবহার করা হয় তাদের। সংখ্যাধিক্য লোকের সংসদে সংখ্যালঘুরা বঞ্চিত। ভারতে ২০ কোটি মুসলিমের বসবাস। বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ ভারত। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরে ভারতের স্থান। ভারতের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলিম। হিন্দুদের সংখ্যা ৮০ শতাংশ। কিন্তু মুসলমানরা সংসদ আসনের মাত্র ৫ শতাংশ দখল করেছে। বিজেপি সংসদ সদসদের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই। কিন্তু ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে তা হয়নি। আইন ও অধিকার অসমভাবে ব্যবহৃত হয় এখানে। 

জনসম্মুখে প্রার্থনার জন্য মুসলমানদের গ্রেফতার করা হয়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের সরকারি কর্মকর্তারা অভিবাদন জানায়। হিন্দু ধর্মকে স্টেট উদযাপন করে। আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উসকে দেয়া হয়। যেমন- মুসলমানদের হিজাব পরাকে বাতিল করা হয়। আজান দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। হিন্দু নজরদারি গ্রুপ মুসলমানদের আক্রমণ করে, তাদের ব্যবসা ধ্বংস করে। সরকারি মদদে হিন্দু সন্ত্রাসীরা মুসলিমদের হত্যা ও ধ্বংসের হুমকি দেয়। সরকার সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে, বিশষ করে যারা ঘৃণার বিরুদ্ধে কথা বলে। মোদির গুজরাটে ২০০২ সালে সংঘটিত দাঙ্গায় মুসলমানকে ধর্ষণ ও পরিবারের ১৪ জনকে হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। ভারতের কোর্টে চার কোটি মামলা স্থগিত আছে। আইনের শাসন নেই বললেই চলে। একসময়ে স্বাধীন ভারতের বিচারব্যবস্থা এখন সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে কাজ করে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মোদির বশংবদ। ভারতীয় পত্রপত্রিকা যখন একসময় গণতন্ত্র রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করতো এখন তারা মোদির রাজত্বকে সমর্থন করতে চাপে রয়েছে। 

ভারতে নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ হয়েছে। সংসদ ভবনের ওপর চার সিংহমূর্তি বসানো হয়েছে। তাদের ক্রোধে দাঁত বের করা। সিংহের প্রসন্ন ভাবমূর্তির লেশমাত্র নেই। মোদি উদ্বোধন করেন। যেন তিনি সমগ্র ভারত ও সারা অঞ্চলকে চিবিয়ে খেতে চায় দাঁত দিয়ে, নখ দিয়ে। সংসদ ভবনকে গণতন্ত্রের মন্দির বললেও মোদির আমলে ডেমি ডেমোক্রেসির সৃষ্টি করছে। আর তা যেন তার কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। বাংলাদেশ ভারতের পাশে বসে আজ এক মোমিন নামক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাকড়সার দাঁত দিয়ে ভারতকে শরীর প্রদানের কসরত করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের দাঁত ও নখসহ সিংহের কাছে আবদার করছে। ভারতের কাছে নিজেকে স্ত্রী হিসেবে জাহির করতে লজ্জা করে না। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে নিজের দেশের জন্য সাহায্য চায়। অথচ বাংলাদেশিদের এই মোমিন কটাক্ষ করে কথা বলে। আর মোমিনের এই বচন কি আসলে ভারতের দ্বারা উসকে দেয়া সিকিমের মতো আরেক ইতিহাসের জন্ম দিবে?

কারণ বাংলাদেশে নাই নির্বাচন, নাই গণতন্ত্র, নাই সমাজতন্ত্র, নাই ধর্মনিরপেক্ষতা, নাই জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর ভারতের গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে যেখানে, তা শেষ হয়ে যাবে সেখানে। বাংলাদেশ সরকার তাই কি ভারতের গেরুয়া বসনে নিরাপত্তা খুঁজছে।

শেয়ার করুন